তিনি বলছেন, আপনাকে ছাড়া আর কারও কাছে তিনি আত্মসমর্পণ করতে চাননি। কারণ, আপনি একজন সরদারের ছেলে এবং তিনি আপনাকে খুব শ্রদ্ধা করেন।
ভরন্তসভ ধন্যবাদ জানানোর জন্য মাথা নাড়লেন। হাজি মুরাদ তার দলের দিকে দেখিয়ে আবার কিছু বললেন।
তিনি বলছেন, এই লোকগুলো তার বিশ্বাসী সমর্থক এবং তার মতো এরাও রুশদের জন্য কাজ করতে চায়।
ভরন্তসভ তাদের দিকে ফিরে মাথা নাড়লেন। প্রফুল্ল, পাপড়িহীন কালো চোখ, চেচেন খান মাহোমাও মাথা নাড়ল এবং এমন কিছু বলল যা হয়তো মজার ছিল, রোমশ আভার ঠোঁট মুচকি হাসল, যাতে তার হাতির দাঁতের মতো চকচকে দাঁত বের হয়ে এল। কিন্তু লালচুলো গামজালোর একমাত্র লাল চোখটি ভরসভের দিকে একনজর দিয়েই তার ঘোড়ার কানের দিকে স্থির হয়ে গেল।
ভরন্তসভ ও হাজি মুরাদ তাদের দলবল নিয়ে দুর্গে ফিরে যাওয়ার পর সৈন্যরা কাজ থেকে ছাড়া পেয়ে এক জায়গায় জড়ো হয়ে নিজেদের মন্তব্য বলাবলি করছিল।
এই শয়তানটা কতগুলো লোক মেরেছে! এখন দেখো তাকে নিয়ে এরা কী অযথা হইচই করে!
স্বাভাবিক, সে ছিল শামিলের ডান হাত, আর এখন কোনো ভয় নেই।
কিন্তু অস্বীকার করতে পারবে না সে একজন চমৎকার লোক। একজন পাকা জিগিত (ককেশীয় অঞ্চলের দক্ষ ঘোড়সওয়ার)।
আর ওই লালটা? লালটা মানুষের দিকে জানোয়ারের মতো পিটপিট করে তাকায়!
হুম, ওইটা নিশ্চয়ই শিকারি কুত্তা!
তারা সবাই লাল লোকটাকে বিশেষভাবে লক্ষ করেছে। গাছ কাটার জায়গায় রাস্তার সবচেয়ে কাছের সৈন্যরা দৌড়ে দেখতে এসেছিল। তাদের অফিসার আগতদের ধমক দিয়েছিল কিন্তু ভরন্তসভ তাকে থামিয়ে দেন।
তাদের পুরোনো বন্ধুদের একবার দেখতে দাও।
তুমি জানো লোকটা কে? সবচেয়ে কাছের সৈন্যটির দিকে ঘুরে তাকিয়ে তার ইংরেজি উচ্চারণে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলেন ভরন্তসভ।
না, জনাব।
হাজি মুরাদ–তার নাম শুনেছ?
আমরা না জানি কী করে, জনাব? আমরা বহুবার তাকে হারিয়েছি!
হ্যাঁ, আমরাও তার কাছ থেকে মার খেয়েছি।
ঠিক বলেছেন, জনাব, তাদের অধিনায়কের সঙ্গে কথা বলতে পারায় খুশি হয়ে সৈন্যটি জবাব দিল।
হাজি মুরাদ বুঝতে পারলেন তারা তার সম্বন্ধেই কথা বলছে, তিনি তার উজ্জ্বল চোখে হাসলেন।
দারুণ উৎফুল্ল মনে ভরন্তসভ দুর্গে ফিরে এলেন।
৬
তরুণ ভরন্তসভ খুব খোশমেজাজে ছিলেন। কারণ, আর কেউ নয়, স্বয়ং তিনি রাশিয়ার সবচেয়ে বড় এবং সক্রিয় শত্রু শামিলের পরের লোকটিকে জয় করতে এবং ঘরে আনতে সফল হয়েছেন। শুধু একটা জিনিস খচখচ করছিল, ভজভিঝেনস্কে সেনাবাহিনীর অধিনায়ক মেলার-জাকোমেলস্কি। আসলে পুরো ঘটনাটাই তার মাধ্যমে হওয়া উচিত ছিল। ভরন্তসভ কোনো খবর না দিয়ে নিজেই পুরো কাজটি করায় অপ্রিয় কিছু হতে পারে। এই চিন্তা তার প্রফুল্লতায় কাঁটার মতো খচখচ করছিল। দুর্গে পৌঁছে তিনি হাজি মুরাদের সহকারীদের দায়িত্ব রেজিমেন্টের অ্যাডজুট্যান্টের হাতে দিয়ে নিজে হাজি মুরাদকে বাড়িতে নিয়ে গেলেন।
অভিজাত পোশাক পরা প্রিন্সেস মারিয়া ভাসিলিয়েভনা তার ছয় বছর বয়সী কোকড়া চুলের সুন্দর ছেলেটিকে নিয়ে বসার ঘরে হাজি মুরাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। হাজি মুরাদ হাত বুকের ওপর রেখে, তার সঙ্গে ঘরে আসা দোভাষীর মাধ্যমে অতি বিনয়ে বললেন, প্রিন্স তাকে বাড়িতে নিয়ে আসায় তিনি নিজেকে প্রিন্সের বন্ধু বলে মনে করেন এবং একজন বন্ধুর পরিবারের সবাই তার কাছে বন্ধুর মতোই পবিত্র।
হাজি মুরাদের চেহারা ও ব্যবহারে মারিয়া ভাসিলিয়েভনা খুশি হলেন এবং নিজের বড় সাদা হাতটি বাড়িয়ে দেওয়ায় তার রক্তিমাভ হয়ে যাওয়াতেও হাজি মুরাদের ভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন মারিয়া। তাঁকে বসার জন্য বলে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কি কফি পান করবেন। কফি পরিবেশন করা হলো। কিন্তু পরিবেশনের পর হাজি মুরাদ তা খেলেন না। হাজি মুরাদ রুশ ভাষা একটু একটু বুঝতেন কিন্তু বলতে পারতেন না। রুশ ভাষার কথা কিছু বুঝতে না পারলে তিনি হাসেন এবং তার হাসিতে মারিয়া ভাসিলিয়েভনা খুশি হলেন, যেমন তা খুশি করেছিল পালতোরাৎস্কিকেও। কোঁকড়া চুল উৎসুক চোখের ছোট ছেলেটি (তার মা যাকে বুক্কা নামে ডাকে) মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে হাজি মুরাদের ওপর থেকে চোখ একটুও সরায়নি, বড় যোদ্ধা হিসেবে যার সুনাম সে শুনেছে।
স্ত্রীর কাছে হাজি মুরাদকে রেখে, তার রাশিয়ার পক্ষে চলে আসার বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রতিবেদন লিখতে ভরন্তসভ তার অফিসে গেলেন। প্রতিবেদন লেখা শেষে গ্রজনিতে লেফট ফ্ল্যাঙ্কের অধিনায়ক-জেনারেল, জেনারেল কজলভস্কি এবং তার বাবার কাছে চিঠি লেখা শেষ হওয়ার পর ভরন্তসভ জলদি বাড়িতে রওনা হলেন, মনে ভয়, একজন ভয়াবহ অপরিচিত লোকের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার জন্য তার স্ত্রী হয়তো তেতে থাকবে। তার ওপর
লোকটির সঙ্গে এমন আচরণ করতে হবে, যাতে সে ক্ষুব্ধ না হয় আবার বেশি বিনয়ীও না হয়। কিন্তু তার শঙ্কার কোনো কারণ ছিল না। হাজি মুরাদ ভরসভের সৎছেলে ছোট্ট বুল্কাকে হাঁটুর ওপর নিয়ে একটা হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে ছিলেন; আর মাথা নিচু করে দোভাষীর মাধ্যমে হাস্যোজ্জ্বল মারিয়া ভাসিলিয়েভনার কথা শুনছিলেন। মারিয়া ভাসিলিয়েভনা বলছিলেন কোনো বন্ধু ভরসভের কোনো কিছুর প্রশংসা করলে ভরন্তসভ তা উপহার হিসেবে দিয়ে দেন, অবস্থা এমন যে, তাকে শিগগিরই এড়ামের মতো জিনিস খুঁজতে নামতে হবে।