কী হয়েছে, বাবা? গুলি লেগেছে? জিজ্ঞেস করল পোলতোরাৎস্কি। কোথায়?
আভদিয়েভ জবাব দিল না।
স্যার, আমি গুলি ভরতে যাচ্ছিলাম, তখন খট করে শব্দ শুনি, আভদিয়েভের পাশে থাকা একজন সৈন্য বলল। আমি তাকিয়ে দেখলাম সে বন্দুক ফেলে দিয়েছে।
টুক টুক টুক! জিব দিয়ে আওয়াজ করল পোলতোরাৎস্কি। খুব ব্যথা লাগছে, আভদিয়ে?
খুব ব্যথা না, কিন্তু দাঁড়াতে পারছি না। স্যার, এক ফোঁটা ভোদকা।
একটু ভোদকা (বা ককেশাসে সৈন্যরা যে মদ পান করে আনা হলো এবং পানভ গম্ভীরভাবে ভুরু কুঁচকে বোতলের মুখ ভর্তি করে আভদিয়েভকে দিল। আভদিয়েভ পান করার চেষ্টা করে সঙ্গে সঙ্গে মুখটা ফিরিয়ে দিল।
আমার পেট উগরে আসছে, সে বলল। তুমি খেয়ে ফেললো।
পানভ মদটুকু পান করল।
আভদিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই আবার পড়ে গেল। তারা একটা চাদর বিছিয়ে তাতে আভদিয়েভকে শুইয়ে দিল।
স্যার, কর্নেল সাহেব আসছেন, পোলতোরাৎস্কিকে জানাল সার্জেন্ট মেজর।
ঠিক আছে, তোমরা একে দেখো? বলে পোলতোরাৎস্কি চাবুক মেরে জোরে দুলকি চালে ভরসভের সঙ্গে দেখা করতে গেল।
ভরন্তসভ তার উন্নত জাতের বিলাতি বাদামি রঙের খোঁজা ঘোড়ায় চড়ে এসেছিলেন, তার সঙ্গে ছিল একজন কসাক অ্যাডজুট্যান্ট এবং একজন চেচেন দোভাষী।
এখানে কী হয়েছে? ভরন্তসভ জিজ্ঞেস করলেন।
একদল চেচেন আমাদের বাইরের লাইনে আক্রমণ করেছিল, পোলতোরাৎস্কি জবাব দিল।
রাখো, রাখো; তুমি নিজেই এগুলো সাজিয়েছ!
না না, প্রিন্স, আমি না, একটু হেসে বলল পোলতোরাৎস্কি, তারা নিজেরাই এগিয়ে গেছে।
শুনলাম একজন সৈন্য আহত হয়েছে?
হ্যাঁ, দুঃখজনক, সে খুব ভালো সৈন্য।
গুরুতর?
গুরুতর, মনে হয় পেটে লেগেছে।
তুমি জানো আমি কোথায় যাচ্ছি? ভরন্তসভ জিজ্ঞেস করলেন।
আমি জানি না।
আন্দাজ করতে পারো?
না। হাজি মুরাদ আত্মসমর্পণ করেছে, আমরা এখন তাকে দেখতে যাচ্ছি।
আপনি সত্যি বলছেন?
গতকাল তার দূত এসেছিল আমার কাছে, তার আনন্দের হাসি কষ্ট করে চেপে রেখে বললেন ভরসভ। কয়েক মিনিটের মধ্যে শালিন ফাঁকা জায়গাটায় সে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। ভোলা জায়গাটা পর্যন্ত লক্ষ্যভেদীদের বসিয়ে দিয়ে আমার সঙ্গে এসো।
বুঝতে পারছি, বলে টুপি ছুঁয়ে অভিবাদন জানিয়ে পোলতোরাৎস্কি চলে গেল তার কোম্পানির কাছে। পাকা লক্ষ্যভেদীদের ডান দিকে বসানোর জন্য নিজে তাদের নিয়ে গেল আর সার্জেন্ট-মেজরকে বাঁ দিকের সারি বসিয়ে দিতে বলল।
কয়েকজন সৈন্য ইতিমধ্যে আহত আভদিয়েভকে দুর্গে নিয়ে যায়।
ভরসভের কাছে ফেরার পথে পোলতোরাৎস্কি দেখতে পেল কয়েকজন ঘোড়সওয়ার তার পিছু পিছু এসে তাকে পার হয়ে যাচ্ছে। সামনে সাদা কেশরের একটি ঘোড়ায় যাচ্ছে জমকালো পোশাকে একজন লোক। তার মাথায় পাগড়ি এবং অস্ত্রগুলোয় সোনা দিয়ে কাজ করা। এই লোকটি হাজি মুরাদ। তিনি পোলতোরাৎস্কির কাছে এসে তাতার ভাষায় কিছু বললেন। ভুরু কুঁচকে, হাত নেড়ে ও মুচকি হেসে পোলতোরাৎস্কি ইশারা করল সে বুঝতে পারেনি। তার স্মিত হাসির জবাবে হাজি মুরাদও স্মিত হাসি হাসলেন এবং সেই শিশুসুলভ হাসিতেই পোলতোরাৎস্কি গলে গেল। পোলতোরাৎস্কি কখনো কল্পনা করেনি পাহাড়িদের ত্রাস সৃষ্টিকারী নেতাটি দেখতে এমন হবে। ভেবেছিল সে দেখতে রুক্ষ এবং শক্তপোক্ত গড়নের হবে; আর তার সামনে এই প্রাণময় লোকটি, তার হাসি এত সরল যে পোলতোরাৎস্কির মনে হয়েছে কতকালের চেনা। তার অবশ্য একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, প্রশস্ত চোখ দুটো কালো ভুরুর নিচ থেকে অন্যদের দিকে মনোযোগ দিয়ে শান্ত অথচ অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকায়।
হাজি মুরাদের দলে ছিল পাঁচজন। তাদের একজন খান মাহোমা, গত রাতে যে প্রিন্স ভরন্তসভের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। গোলাপি আভার গায়ের রং, গোল মুখ এবং পাপড়িহীন চোখে প্রফুল্ল দৃষ্টি, যেন জীবনের আনন্দে পূর্ণ। আর ছিল আভার খানেফি, রোমশ মোটাসোটা মানুষ, জোড়া ভুরু। হাজি মুরাদের সব সম্পত্তির দায়িত্ব ছিল তার ওপর, সে একটা খোঁজা। ঘোড়ায় জিনের সঙ্গে লাগানো বস্তাবোঝাই জিনিসপত্র নিয়ে আসছিল। দলের দুজন লোক ছিল বিশেষ লক্ষণীয়। প্রথমজন দাগেস্তানের পাহাড়ি এলাকার এক তরুণ, চওড়া কাধ, কিন্তু কোমর মেয়েদের মতো সরু, মুখে বাদামি দাড়ি কেবল গজাতে শুরু করেছে, চোখ ভেড়ার চোখের মতো সুন্দর। এ হলো এলডার। অন্যজন গামজালো, একজন চেচেন, এক চোখ কানা, ভুরু বা পাপড়ি নেই, ছোট লাল দাড়ি এবং তার মুখ ও নাকের ওপর আড়াআড়ি কাটা দাগ। পোলতোরাৎস্কি হাজি মুরাদকে দেখাল ভরন্তসভ রাস্তায় উঠে এসেছেন। ঘোড়া চালিয়ে হাজি মুরাদ তার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন, তার ডান হাত বুকের ওপর রেখে তার ভাষায় কিছু বলে থামলেন। চেচেন দোভাষী তা বুঝিয়ে দিল।
সে বলছে, আমি রুশ জারের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করলাম। আমি তার সেবা করতে চাই, সে বলছে, আমি অনেক আগে থেকেই তা করতে চেয়েছি কিন্তু শামিল করতে দেয়নি।
দোভাষীর কথা শুনে ভরন্তসভ তার শ্যাময় চামড়ার দস্তানায় ভরা হাত হাজি মুরাদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। হাজি মুরাদ ক্ষণিকের জন্য হতভম্ব হয়ে পরক্ষণে তা দৃঢ়ভাবে চাপ দিয়ে ধরলেন, আবার কিছু বললেন প্রথমে দোভাষীর দিকে তাকিয়ে, তারপর তাকালেন ভরসভের দিকে।