তারা যখন অস্ত্র, লাগাম ও ঘোড়াগুলো পরিষ্কার করছিল, আকাশের তারারা তখন ডুবে গিয়েছে। আলো বেশ ফুটে উঠেছে এবং সকালের মন্দ বাতাস বইতে শুরু করেছে।
তারা যখন অস্ত্র, লাগাম ও ঘোড়াগুলো পরিষ্কার করছিল, আকাশের তারারা তখন ডুবে গিয়েছে। আলো বেশ ফুটে উঠেছে এবং সকালের মন্দ বাতাস বইতে শুরু করেছে।
খুব সকালে অন্ধকার থাকতে থাকতেই পোলতোরাৎস্কির অধীনে দুটো কোম্পানি শাহগিরনস্কি ফটক দিয়ে বের হয়ে কুচকাওয়াজ করে ছয় মাইল পার হয়ে এল। এক সারি অব্যর্থ লক্ষ্যভেদী বসিয়ে দিনের আলো ফোঁটামাত্র তারা গাছ কাটতে শুরু করল। আটটার দিকে আগুনের কুণ্ডলীতে হিসহিস পটপট করে ফুটতে থাকে ভেজা কাঁচা ডালগুলো। ওগুলো থেকে ওঠা সুগন্ধি ধোয়ার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে কুয়াশা। গাছ কাটিয়েরা এতক্ষণ পাঁচ হাত দূরের জিনিসও দেখতে পাচ্ছিল না; শুধু একজন আরেকজনের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল। এখন তারা আগুনের কুণ্ড এবং কাটা গাছে বন্ধ বনের রাস্তাটি দেখতে পাচ্ছিল। কুয়াশার মধ্যে সূর্যকে একবার উজ্জ্বল একটা ফোঁটার মতো দেখাচ্ছিল, আবার তা চলে যাচ্ছিল।
রাস্তা থেকে একটু দূরে বনের ফাঁকা জায়গাটায় তৃতীয় কোম্পানির দুই অফিসার পোলতোরাৎস্কি এবং তার অধস্তন তিখোনভ এবং মারামারি করার জন্য পদাবনতি পাওয়া অশ্বারোহী গার্ড বাহিনীর সাবেক অফিসার ব্যারন ফ্রিজ ঢাকগুলোর ওপর বসে ছিল। ফ্রিজ ছিল ক্যাডেট কলেজে পোলতোরাৎস্কির সহপাঠী। খাবার মোড়ানো কাগজের টুকরা, সিগারেটের গোড়া এবং কিছু খালি বোতল ঢাকগুলোর চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। অফিসাররা আগে ভোদকা পান করেছে, এখন চলছিল খাওয়া আর পোর্টার বিয়ার পান। একজন ঢাকবাদক তাদের তৃতীয় দফায় বোতলের ছিপি খুলে দিচ্ছিল।
পোলতোরাৎস্কি রাতে যথেষ্ট ঘুমাতে পারেনি। কিন্তু বিপদের আশঙ্কার মধ্যে এবং অধীন সৈন্য ও সহকর্মীদের সঙ্গে থাকলে সে বিশেষ উল্লাস ও বেখেয়ালি আনন্দ অনুভব করে। সে তখনো ঠিক তেমন বোধ করছিল।
অফিসাররা কথাবার্তা বলছিল প্রফুল্ল মনে, তার বিষয় ছিল পাওয়া সর্বশেষ খবর : জেনারেল স্লেপ্তসভের মৃত্যু। তাদের কেউ এই মৃত্যুকে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, জীবনের সমাপ্তি এবং যেখানে উৎপত্তি, সেখানেই ফিরে যাওয়ার মুহূর্ত হিসেবে দেখছিল না। বরং তারা এটাকে কেবল একজন সাহসী যোদ্ধার বীরত্ব হিসেবে দেখছিল, যে তলোয়ার হাতে নিয়ে পাহাড়িদের দিকে ছুটে গিয়ে তাদের কচুকাটা করছিল।
তাদের সবাই যদিও জানত, বিশেষ করে যারা যুদ্ধ করেছে এবং না জেনে উপায় ছিল না যে তখনকার দিনে ককেশাসে কখনো, সত্যি বলতে কি, কোনোখানেই কখনো মুখোমুখি তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করা হয় না। কারণ, সব সময় মনে করা হয় এবং বলা হয় যে তলোয়ার বা বেয়নেট দিয়ে শুধু পালাতে থাকা যোদ্ধাদের কোপানো যায়। মুখোমুখি যুদ্ধের সেই গল্পে পাওয়া অহংকার ও উৎফুল্লতা নিয়ে তারা ঢাকের ওপর বসে (কেউ হালকা মেজাজে, অন্যরা তার উল্টো খুব বিনয়ীভাবে) পান আর হাসিঠাট্টা করছিল। যে মৃত্যু স্লেপ্তসভকে নিয়ে গেছে, তেমনি তাদেরও যেকোনো সময় নিয়ে যেতে পারে, এই দুশ্চিন্তা তাদের ছিল না এবং তাদের কথার মাঝখানে, যেন তাদের আশঙ্কার প্রমাণ হিসেবে তারা রাস্তার বাঁ দিকে রাইফেলের গুলির শব্দ শুনতে পেল। একটা বুলেট শিসস শব্দ করে বাতাসের মধ্য দিয়ে তাদের কাটিয়ে গিয়ে একটা গাছে লাগল।
হে হো আনন্দে চিৎকার করে উঠল পোলতারাৎস্কি, এটা তো আমাদের লাইনেই এসেছে…কস্টিয়া, তারপর ফ্রিজের দিকে ফিরে বলল, তোমার ভাগ্য ভালো। কোম্পানির কাছে ফিরে যাও। আমরা অল্পক্ষণের মধ্যেই যুদ্ধে নামব, খুব মজা হবে। আমরা দেখিয়ে দেব।
ফ্রিজ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত ধোয়ায় ঢাকা জায়গাটার দিকে কোম্পানির কাছে চলে গেল।
পোলতোরাৎস্কির কালো লেজ ও কেশরওয়ালা তামাটে রঙের ছোট কাবার্ডা ঘোড়াটাকে তার কাছে আনা হলো। সে ওটায় চড়ে গিয়ে কোম্পানিকে নিয়ে যেদিক থেকে গুলি এসেছিল, সেদিকে রওনা হলো। পাহারাচৌকি বসানো হয়েছিল বনের কিনার ঘেঁষে, খাদের ভোলা ঢালের পাশে। বাতাস বইছিল বনের দিকে, শুধু খাদের ঢালটাই না, অপর দিকটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। পোলতোরাৎস্কি সীমার কাছে পৌঁছালে কুয়াশার পেছন থেকে সূর্য বের হয়ে এল এবং গিরিখাদের অন্য পারে একটা নতুন বনের কিনারে, প্রায় সিকি মাইল দূরে, কয়েকজন ঘোড়সওয়ার চোখে পড়ল। তারা ছিল হাজি মুরাদকে ধাওয়া করা চেচেন এবং তারা দেখতে চাচ্ছিল যে হাজি মুরাদ রুশদের সঙ্গে দেখা করেছে। তাদের একজন সৈন্যদলের দিকে গুলি ছুড়ল। কয়েকজন সৈন্য পাল্টা গুলি ছুড়ল। চেচেনরা পিছু হটে গেলে গোলাগুলি বন্ধ হলো।
কিন্তু তা সত্ত্বেও পোলতোরাৎস্কি কোম্পানি নিয়ে হাজির হয়ে গুলি চালানোর আদেশ দিল। তার আদেশ মুখ দিয়ে বের হতে না-হতেই অব্যর্থ লক্ষ্যভেদীদের সারি থেকে সবাই আনন্দে-উত্তেজনায় রাইফেলের খটাখট শব্দে সুন্দর করে মিলিয়ে যাওয়া ছোট ছোট ধোঁয়ার কুণ্ডলী তুলে অবিরাম গুলি চালাতে শুরু করল। একঘেয়েমি কাটানোর কিছু পেয়ে খুশি সৈন্যরা, দ্রুত রাইফেল ভরে একের পর এক গুলি চালায়। চেচেনরাও উত্তেজনায় একের পর এক লাফিয়ে সামনে এসে সৈন্যদের দিকে কিছু গুলি চালায়। তার একটা গুলিতে একজন সৈন্য আহত হয়। এ হলো সেই আভদিয়েভ, যে আগের রাতে ওত পাতার জায়গায় শুয়ে ছিল। সহযোদ্ধারা তার কাছে এসে দেখে সে উপুড় হয়ে দুহাতে আহত পেট চেপে ধরে মাথা নিচু করে পড়ে আছে এবং এদিক-ওদিক দুলছে আর আস্তে আস্তে গোঙাচ্ছে। সে পোলতোরাৎস্কির কোম্পানির। পোলতোরাৎস্কি কয়েকজন সৈন্যকে জড়ো হতে দেখে তাদের কাছে গেল।
© 2023 BnBoi - All Right Reserved
© 2023 BnBoi - All Right Reserved