একজন লোক চট করে দাঁড়াল এবং হাজি মুরাদের কাছে গিয়ে লাগাম ও পাদানি ধরে দাঁড়াল। সে ছিল হাজি মুরাদের ধর্মভাই, তার বাড়ির সবকিছুর দেখাশোনা করত।
আগুনটা নিভিয়ে দাও, ঘোড়া থেকে নামতে নামতে হাজি মুরাদ বললেন।
লোকগুলো কুণ্ডটা ভেঙে ছড়িয়ে দিল এবং পোড়া ডালগুলো মাড়াতে শুরু করল।
বাটা এখানে এসেছিল? মাটিতে বিছানো একটি চাদরের কাছে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলেন হাজি মুরাদ।
হ্যাঁ, সে অনেক আগে খান মাহোমাকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেছে।
কোন দিকে গেছে?
ওই দিকে, হাজি মুরাদ যেদিক দিয়ে এসেছে, তার উল্টো দিক দেখিয়ে জবাব দিল খানেফি।
ঠিক আছে, বলে হাজি মুরাদ কাঁধ থেকে রাইফেল নামিয়ে তাতে গুলি ভরতে শুরু করলেন।
আমাদের খুব সাবধান থাকতে হবে। আমার পেছনে ধাওয়া করেছিল, আগুন নেভাতে থাকা একটা লোককে বললেন হাজি মুরাদ।
লোকটার নাম গামজালো, চেচেন। গামজালো চাদরটার কাছে গিয়ে সেটার ওপর থেকে একটা রাইফেল তুলে নিয়ে সেটাকে ঢাকনায় ঢেকে কোনো কথা না বলে বনের ভেতরের খোলা জায়গাটার, যেদিক দিয়ে হাজি মুরাদ এসেছিলেন, সেদিকে চলে গেল।
এলডার ঘোড়া থেকে নেমে হাজি মুরাদ এবং তার ঘোড়াটিকে নিয়ে দুটোর মুখ উঁচু করে দুটো গাছের সঙ্গে লাগাম দিয়ে বেঁধে রাখল। তারপর গামজালোর মতো রাইফেল নিয়ে খোলা জায়গাটার অপর দিকে চলে গেল। আগুনের কুণ্ডটা নেভানো হয়ে গিয়েছিল, বনটাকে আর অত অন্ধকার মনে হচ্ছিল না। আকাশে তারা জ্বলছিল কিন্তু আবছাভাবে।
তারাগুলোর দিকে চোখ তুলে তিনি দেখলেন কৃত্তিকাগুলো (সাত বোন নামে পরিচিত নক্ষত্রগুচ্ছ) উঠে মধ্যাকাশে চলে এসেছে। হাজি মুরাদ অনুমান। করলেন, মাঝরাত অনেক আগেই পেরিয়েছে এবং এশার নামাজ কাজা হয়ে গেছে। তিনি খানেফিকে একটা বদনা দিতে বললেন (তারা সব সময় তাদের জিনিসপত্রের সঙ্গে একটা রাখে) এবং চাদর মুড়ি দিয়ে নালাটির দিকে গেলেন।
জুতো খোলার পর অজু করে হাজি মুরাদ আবার চাদরটা গায়ে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলেন, তারপর পুব দিকে ফিরে কানের লতি ছুঁয়ে নামাজ পড়তে শুরু করলেন।
নামাজ শেষ হলে জিনে ঝোলানোর থলিগুলো রাখা জায়গাটার কাছে গিয়ে কনুই দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন।
নিজের ভাগ্যের ওপর হাজি মুরাদের গভীর বিশ্বাস। কোনো কিছুর পরিকল্পনা করার সময় সাফল্যের দৃঢ় আস্থা তিনি আগাম পেয়ে যেতেন এবং ভাগ্য তার ওপর প্রসন্ন ছিল। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া তার সামরিক জীবনের পুরোটাজুড়েই এমন হয়েছে। তাই তিনি আশা করছিলেন এখনো তেমন হবে। তিনি মনে মনে ছবি দেখছেন। তার অধীনে ভরসভের দেওয়া সৈন্যদের নিয়ে তিনি শামিলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাকে বন্দী করে প্রতিশোধ নিচ্ছেন এবং রাশিয়ার জার তাকে পুরস্কৃত করছেন। তিনি আবার শুধু আভারিয়া নয়, তার কাছে আত্মসমর্পণ করা পুরো চেচনিয়া শাসন করবেন। এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন, টের পাননি।
তিনি স্বপ্ন দেখলেন, তার সাহসী অনুসারীরা কী করে গান গাইতে গাইতে এবং মুরাদের আগমন…! ধ্বনি দিতে দিতে শামিলকে ধাওয়া করছে। কী করে শামিল ও তার স্ত্রীদের আটক করছে এবং তিনি শামিলের স্ত্রীদের কান্না ও গোঙানি শুনতে পাচ্ছেন। তার ঘুম ভেঙে গেল। গান ও হাজি মুরাদের আগমন! ধ্বনি এবং শামিলের স্ত্রীদের কান্না হিসেবে যা শুনছিলেন, তা ছিল শিয়ালের ক্রুর হাসি এবং হুক্কা রব, যার শব্দে তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। হাজি মুরাদ মাথা তুলে তাকালেন আকাশের দিকে। গাছের গুঁড়িগুলোর ফাঁক দিয়ে যেটুকু দেখা যায়, তাতে পুব দিকে ইতিমধ্যে আলো দেখা যাচ্ছে। তার একটু দূরে বসে থাকা একজন মুরিদের কাছে খান মাহোমার কথা জিজ্ঞেস করলেন। খান মাহোমা এখনো আসেনি শুনে আবার মাথা নোয়ালেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লেন।
তার ঘুম ভাঙল বাটার সঙ্গে অভিযান থেকে ফিরে আসা খান মাহোমার উৎফুল্ল গলার আওয়াজে। খান মাহোমা সঙ্গে সঙ্গে হাজি মুরাদের পাশে বসে পড়ল এবং বলতে লাগল সৈন্যরা তাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করল এবং কেমন করে খোদ প্রিন্সের কাছে নিয়ে গেল। প্রিন্স কত খুশি হয়েছিল, সকালে তাদের সঙ্গে দেখা করার কী অঙ্গীকার করেছিল, মিচিক থেকে একটু দূরে, শালিন নামের ফাঁকা জায়গাটার কোনখানে রুশরা গাছ কাটতে যাবে–এই সব। বাটা তার নিজের বর্ণনা দিতে সঙ্গী দূতকে মাঝেমধ্যে থামিয়ে দিচ্ছিল।
হাজি মুরাদ বিশেষ করে জানতে চাচ্ছিলেন তার রুশদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার প্রস্তাবের জবাবে ভরন্তসভ ঠিক কী বলেছে। খান মাহোমা আর বাটা একই কথা বলল যে প্রিন্স হাজি মুরাদকে মেহমান হিসেবে বরণ করার এবং তার জন্য ভালো হবে, এমন কাজ করার অঙ্গীকার করেছেন।
তারপর হাজি মুরাদ তাদের রাস্তার অবস্থা জিজ্ঞেস করলেন। খান মাহোমা রাস্তাটা ভালো চেনে এবং তাকে ঠিক জায়গায় নিয়ে যাবে বলে আশ্বস্ত করল। শুনে হাজি মুরাদ কিছু টাকা নিয়ে বাটাকে দিলেন এবং তার আগের কথামতো তিনটি রুবলও দিলেন। তারপর তার মুরিদদের জিনের থলে থেকে সোনায় মোড়া অস্ত্র ও পাগড়ি বের করে সেগুলো পরিষ্কার করতে বললেন, যাতে রুশদের সামনে গেলে তাদের ভালো দেখায়।