রাত আরও গম্ভীর হলে মেহমানদের ঘরের দরজাটা কাঁচ কাঁচ করে উঠল, হাজি মুরাদ সঙ্গে সঙ্গে জেগে পিস্তলের ওপর হাত রেখে উঠে বসলেন। মাটির মেঝেয় পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকল সাদো।
কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করলেন হাজি মুরাদ, যেন তিনি একদমই ঘুমাননি।
আমাদের চিন্তার ব্যাপার, তার সামনে উবু হয়ে বসে বলল সাদো। এক মহিলা তাদের ছাদ থেকে আপনাকে আসতে দেখেছে এবং তার স্বামীকে বলে দিয়েছে; এখন গ্রামের সবাই জানে। একজন প্রতিবেশী আমার স্ত্রীকে এইমাত্র বলেছে যে মুরব্বিরা সবাই মসজিদে জমায়েত হয়েছে, তারা আপনাকে আটকাতে চায়।
আমাকে তাহলে যেতে হবে! হাজি মুরাদ বললেন।
ঘোড়াগুলোয় জিন লাগানো আছে, বলে কুঁড়ে থেকে দ্রুত বের হয়ে গেল। সাদো।
এলডার! ফিসফিস করে ডাকলেন হাজি মুরাদ। এলডার তার নাম শুনে, তার চেয়ে বেশি তার মনিবের গলা শুনে, হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তার টুপিটা ঠিক করল।
হাজি মুরাদ তার অস্ত্রগুলো ঝুলিয়ে চাদর পরে নিলেন। এলডারও তা-ই করল; তারা দুজনই নিঃশব্দে কুঁড়ে থেকে বারান্দায় বের হয়ে এলেন। কালো চোখের ছেলেটা তাদের ঘোড়া দুটো নিয়ে এসেছিল। শক্ত মাটির ওপর ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনে পাশের একটি কুঁড়ের দরজা দিয়ে মাথা বের করে দেখল, একটা লোক এবং তার খড়মে খটাশ খটাশ শব্দ তুলে দৌড়ে পাহাড় বেয়ে মসজিদের দিকে গেল। চাঁদ ছিল না। কিন্তু কালো আকাশে তারাগুলো জ্বলজ্বল করছিল। তাতে অন্ধকারে কুঁড়েঘরগুলোর চালের আকার বোঝা যায়। সব কটি ঘরের চেয়ে উঁচু মিনারসহ মসজিদটি গ্রামের ওপরের দিকটায়। সেখান থেকে মানুষের গুঞ্জন ভেসে আসছিল।
বন্দুকটা হাতে নিয়ে হাজি মুরাদ পাদানিতে পা রেখে নিঃশব্দে তার শরীর জিনের উঁচু গদির ওপর তুলে দিলেন।
আল্লাহ তোমার ভালো করুন, তার মেজবানকে বললেন। অভ্যাসমতো ডান পাদানিতে পা ঢুকিয়ে যে ছেলেটি ঘোড়া ধরে রেখেছিল, তাকে চাবুক দিয়ে ছুঁয়ে যেতে দেওয়ার ইশারা করলেন। ছেলেটি এক পাশে সরে দাঁড়াল এবং বড় রাস্তার পথ ধরে জোরে হাঁটতে শুরু করল ঘোড়াটা। যেন ওটার জানাই ছিল কী করতে হবে। এলডার চলছিল তার পিছে। সাদো তার চামড়ার পোশাকে হাত দুলিয়ে সরু পথটা ধরে প্রায় দৌড়ে তাদের পিছু পিছু চলছিল। দুই রাস্তার মোড়ে প্রথমে একটা, তারপর আরেকটা ছায়া রাস্তার ওপর এসে পড়ে।
দাঁড়াও। কে? থামো! চিৎকার করে কেউ বলল এবং কয়েকটা লোক রাস্তা আটকে দাঁড়াল।
হাজি মুরাদ না থেমে বেল্ট থেকে পিস্তলটা হাতে নিয়ে রাস্তা আটকানো লোকগুলোর দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন। লোকগুলো দুপাশে সরে দাঁড়াল। হাজি মুরাদ কোনো দিকে না তাকিয়ে জোর কদমে ঘোড়া ছোটালেন। এলডার তাকে অনুসরণ করল দুলকি কদমে। তাদের দিকে দুটো গুলি ছোঁড়া হলো, শাই শাঁই করে গুলি দুটো তাদের পাশ দিয়ে চলে গেল হাজি মুরাদ বা এলডারকে আঘাত না করেই। হাজি মুরাদ একই বেগে ছুটতে থাকলেন কিন্তু প্রায় তিন শ গজ যাওয়ার পর সামান্য ঊর্ধ্বশ্বাস নেওয়া ঘোড়াটি থামিয়ে কিছু শোনার চেষ্টা করলেন।
তার সামনে, নিচে, কলকল করে পানির ধারা বয়ে যাচ্ছিল। পেছনের গ্রামটিতে মোরগগুলো ডাকছিল একের পর এক, যেন একটা আরেকটার জবাব দিচ্ছিল। এসব ছাপিয়ে তিনি তার পেছনে এগিয়ে আসা একদল ঘোড়ার ভারী পায়ের আওয়াজ এবং কয়েকটি লোকের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছিলেন। হাজি মুরাদ তার ঘোড়াটি স্পর্শ করে সমান গতিতে চলতে থাকলেন। তার পেছনের লোকেরা ঘোড়া দৌড়িয়ে তাকে প্রায় ধরে ফেলল। জনা বিশেক ঘোড়সওয়ার, গ্রামটির বাসিন্দা। তারা হাজি মুরাদকে আটকাতে চেয়েছিল, না হলেও অন্তত শামিলকে দেখাতে চেয়েছিল যে তারা হাজি মুরাদকে আটকাতে চেষ্টা করেছে। অন্ধকারের মধ্যে দেখা যাওয়ার মতো কাছে এলে হাজি মুরাদ থামলেন। লাগাম ছেড়ে দিয়ে অভ্যস্ত বাঁ হাত দিয়ে তার রাইফেলের ঢাকনার বোতাম খুললেন। ডান হাত দিয়ে রাইফেলটি তুলে নিলেন। এলডারও তা-ই করল।
তোমরা কী চাও? চিৎকার করে বললেন হাজি মুরাদ। তোমরা আমাকে ধরতে চাও! তাহলে এসো, ধরো! এবং তিনি রাইফেল তুললেন। গ্রামের মানুষগুলো থেমে গেল এবং হাজি মুরাদ রাইফেলটি হাতে রেখে উপত্যকায় নামলেন। ঘোড়সওয়ারেরাও তাকে অনুসরণ করল, কিন্তু আরও কাছে গেল না। হাজি মুরাদ উপত্যকার অপর দিকে চলে যাওয়ার পর লোকগুলো চিৎকার করে বলল যে তারা যা বলতে চায়, তার তা শোনা উচিত। জবাবে তিনি রাইফেলের একটা গুলি ছুঁড়ে জোরকদমে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ পর লাগাম টেনে ঘোড়ার গতি একটু কমিয়ে দিলেন। তাকে ধরতে আসা লোকগুলোর কোনো শব্দ, মোরগের ডাকগুলো আর শোনা যাচ্ছে না। বনের ভেতরে পানির নালার কলকল শব্দ আরও পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। তারপর একটা প্যাচা ডেকে উঠল। বনের কালো দেয়াল মনে হলো বেশ কাছেই। এটাই সেই বন মুরিদেরা যেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে।
বনের পাশে পৌঁছে হাজি মুরাদ থামলেন। বুকভরে দম নিয়ে শিস দিয়ে নীরবে অপেক্ষা করলেন কিছু শোনার চেষ্টায়। একটু পর বনের ভেতর থেকে একই রকম শিসের জবাব এল। হাজি মুরাদ রাস্তা থেকে নেমে বনের ভেতরে ঢুকলেন। প্রায় এক শ কদম যাওয়ার পর গাছের গুঁড়িগুলোর ফাঁকে দেখতে পেলেন একটা আগুনের কুণ্ড, তার চারপাশে বসা কিছু লোকের ছায়া এবং আগুনের আধো আলোয় দেখা গেল জিন লাগানো একটা ঘোড়া দাঁড়িয়ে। কুণ্ডের পাশে চারজন লোক বসে ছিল।