‘কি পাজি! আমি বলেছিলাম, কিন্তু না; কেন! তিন বছরের মধ্যে উনি জোগাড় করে উঠতে পারলেন না’, সতেজে বলছিলেন অনুচ্চ চেহারার কোলকুঁজো এক জমিদার, পমেডের প্রলেপ দেওয়া তাঁর চুল এসে পড়েছে উর্দির নকশা- তোলা কলারের ওপর। নতুন, বোঝা যায় নির্বাচন উপলক্ষেই কেনা বুটের হিল সজোরে ঠুকছিলেন তিনি। লেভিনের দিকে একটা বিরক্ত দৃষ্টিপাত করে জমিদার ঝট করে ঘুরে গেলেন।
‘কারসাজি আছে, সে আর বলতে’, সরু গলায় বললেন ক্ষুদ্রকায় আরেক জমিদার
এই দুজনের পেছনে মোটাসোটা এক জেনারেলকে ঘিরে জমিদারদের পুরো একটা ঝাঁক তাড়াতাড়ি করে এগিয়ে আসছিল লেভিনের দিকে। জমিদাররা স্পষ্টতই একটা জায়গা খুঁজছিল যেখানে কথা বললে অন্যের কানে যাবে না।
‘কি স্পর্ধা, বলে কিনা ওর ট্রাউজার চুরি করতে বলেছি আমি! বেচে দিয়ে মদ টেনেছে বলে মনে হয়। ওকে আর
ওর প্রিন্স কেতাবকে আমি কেয়ার করি থোড়াই। কথা বলতে এসো না, এটা খচরামি!’
‘কিন্তু ওরা যে আইনের ধারার আশ্রয় নিয়েছে’, কথা হচ্ছিল আরেকটা গ্রুপে, ‘তাঁর স্ত্রীকে অভিজাত বলে তালিকাভুক্ত করা উচিত!’
‘চুলোয় যাক গে ধারা! আমি অন্তর থেকে কথা বলছি। ঘরানা অভিজাত। বিশ্বাস করতে হয়।’
‘হুজুর, চলুন যাই, চমৎকার শ্যাম্পেন!
একজন অভিজাত প্রচণ্ড চিৎকার করে কি যেন বলছিল এবং আরেকটা দল আসছিল তার পিছু পিছু; মদ খাইয়ে মাতাল করা তিন জনের মধ্যে সে একজন।
মারিয়া সেমিওনোভনাকে আমি সব সময়ই বলেছিলাম জমি খাজনায় দিতে, কেননা নিজে উনি চালাতে পারেন না’, শ্রুতিমধুর গলায় বললেন মোচ পাকা এক জমিদার, পরনে সাবেকী জেনারেল স্টাফের কর্নেলী উর্দি; ইনি সেই জমিদার লেভিন যাঁকে দেখেছিলেন সি্ভ্য়াজ্স্কির ওখনে। সাথে সাথেই তাঁকে চিনতে পারেন তিনি। জমিদারও লেভিনের দিকে ভালো করে তাকিয়ে সম্ভাষণ বিনিময় করলেন।
‘ভারি আনন্দ হল। চিনব না মানে! বেশ ভালো মনে আছে। গত বছর। অভিজাতপ্রমুখ সি্ভ্য়াজ্স্কির ওখানে।’
‘তা আপনার কৃষিকর্ম কেমন চলছে?’ জিজ্ঞেস করলেন লেভিন।
‘সেই একই রকম লোকসানে’, জমিদার বললেন বিনীত হাসি ফুটিয়ে, কিন্তু এই প্রশান্তি ও প্রত্যয় নিয়ে যে তাই- ই হওয়া দরকার। লেভিনের কাছে দাঁড়ালেন তিনি, জিজ্ঞেস করলেন; ‘কিন্তু আপনি আমাদের গুবের্নিয়ায় যে? আমাদের কু’দেতায় যোগ দিতে এসেছেন?’ ফরাসি শব্দটা বললেন তিনি দৃঢ় কিন্তু খারাপ উচ্চারণে। ‘সারা রাশিয়া চলে এসেছে, কামেরহেররাও, প্রায় মন্ত্রীরাও’, অব্লোন্স্কির দর্শনধারী মূর্তির দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বললেন। সাদা পেন্টালুন আর কামেরহেরী উর্দিতে তিনি হাঁটছিলেন এক জেনারেলের সাথে।
‘আমি আপনার কাছে স্বীকার করছি যে অভিজাত নির্বাচনের গুরুত্ব আমি বুঝি কম’, লেভিন বললেন।
‘বোঝার আবার আছেটা কি? কোন গুরুত্বই নেই। ক্ষীয়মাণ একটা প্রতিষ্ঠান চলে যাচ্ছে জাড্যের শক্তিতে উর্দিগুলো দেখুন, তা দেখেই বুঝতে পারবেন, এটি সালিশী জজ, স্থায়ী সদস্য ইত্যাদির সমাবেশ, অভিজাতদের নয়।’
‘তাহলে আপনি আসেন কেন?’ জিজ্ঞেস করলেন লেভিন।
‘প্রথম অভ্যাসবশে। তাছাড়া যোগ সম্পর্কাদি রাখতে হয়। কিছু পরিমাণ নৈতিক দায়িত্বও। আর সত্যি বললে, নিজের স্বার্থও আছে। আমার জামাতা স্থায়ী সদস্য নির্বাচনে দাঁড়াতে চায়। ওরা ধনী নয়, তাই ওকে চালু করে দেওয়া দরকার। কিন্তু ওনারা আসেন কেন?’ বিষজিহ্বা যে ভদ্রলোকটি রাজ্যপালের টেবিলে থেকে কথা বলেছিলেন তাকে দেখিয়ে বললেন তিনি।
‘এরা অভিজাত সম্প্রদায়ের নতুন পুরুষ।’
‘নতুন নয় হল। কিন্তু অভিজাত নয়। ওরা জমিদার আর আমরা ভূস্বামী। অভিজাত হিসেবে ওরা নিজেই নিজেদের খতম করেছে।’
‘কিন্তু আপনি নিজেই তো বললেন যে, আয়ু ফুরিয়েছে প্রতিষ্ঠানটার।’
‘ফুরিয়েছে ফুরাক। তাহলেও সম্মান দেখাতে হয়। অন্তত স্নেকোভকে….আমরা ভালো হই, না হই, হাজার বছর ধরে বাড়ছি। ধরুন আপনি বাড়ির সামনে একটা বাগান করতে চান আর সেখানে রয়েছে একশ বছরের একটা গাছ… সে গাছ দরকচামারা বুড়ো হলেও ফুলবাগান আর কেয়ারির জন্য তাকে কাটতে তো যাবেন না। বরং ফুলবাগানগুলো এমনভাবে বসাবেন যাতে কাজে লাগে গাছটা। ওটা তো আর এক বছরে বেড়ে উঠেবে না’, সাবধানে এই কথা বলে সাথে সাথেই প্রসঙ্গ পাল্টালেন তিনি, ‘তা আপনার কৃষিকর্ম কেমন চলছে?’
‘খারাপ। শতকরা পাঁচ।
‘হ্যাঁ, অথচ নিজেকে আপনি ধরছেন না। আপনারাও তো কিছু দাম আছে। শুনুন, নিজেন কথা বলি। যতদিন আমি ফৌজের ছিলাম, কৃষিকর্মে লাগিনি। পেতাম তিন হাজার। আর এখন ফৌজের চেয়ে বেশি খাটছি, কিন্তু পাচ্ছি আপনার মতই শতকরা পাঁচ, তাও সৃষ্টিকর্তা দেন। নিজের খাটুনির গেল বেফায়দা।
‘তাহলে কেন এটা করছেন? যখন সোজাসুজি লোকসান?’
‘অথচ করছি। উপায় নেই। অভ্যাস আর কি, জানি যে তাই করা দরকার। আপনাকে আরো বলি’, জানালার বাজুতে কনুই ভর দিয়ে উনি বলে চললেন, ‘কৃষিকর্মে ছেলের কোনরকম আগ্রহ নেই। বোঝা যাচ্ছে, পণ্ডিত হবে। অথচ কাউকে তো চালিয়ে যাওয়া দরকার। তাই করি। এই তো এ বছর বাগান বসালাম।’
‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, কতটা সম্পূর্ণ ঠিক’, লেভিন বললেন, ‘আমি সব সময় টের পাই যে আমার বিষয়-আশয়ে সত্যিকার কোন ফায়দা নেই। অথচ করে যাই। জমির জন্যে একটা কেমন যেন দায়িত্ব।’