মস্কোয় যেন ঘোরের মধ্যে দুমাস কাটিয়ে, প্রতি দিন সমাজে কিটিতে দেখে, তার সাথে দেখা করার জন্যই সেখানে তিনি যেতেন, লেভিন হঠাৎ ঠিক করলেন, এ হতে পারে না এবং চলে গেলেন গ্রামে।
এ হতে পারে না, লেভিনের এমন প্রত্যয়ের ভিত্তি ছিল এই যে আত্মীয়-স্বজনদের চোখে তিনি ছিলেন মাধুরীময়ী কিটির পক্ষে অলাভজনক অযোগ্য পাত্র আর কিটি নিজে তাঁকে তো ভালোবাসতেই পারে না। আত্মীয়-স্বজনদের চোখে তিনি প্রচলিত সুনির্দিষ্ট কোন কাজে নিযুক্ত নন, সমাজেও কোন প্রতিষ্ঠা নেই, যে ক্ষেত্রে ওঁর বত্রিশ বছর বয়সে বন্ধুরা ইতিমধ্যেই কেউ কর্নেল, কেউ এইডডেকং, কেউ প্রফেসর, কেউ ব্যাঙ্ক আর রেলপথের ডিরেক্টর, কেউ-বা অবলোনস্কির মত সরকারি অফিসের অধিকর্তা; আর উনি ওদিকে (অন্য লোকের কাছ তাকে কেমন লাগার কথা সেটা তিনি ভালোই জানতেন) জমিদারি চালাচ্ছেন, গো-পালন করছেন, পাখির কোটরে গুলি মারছেন, আর এটা-ওটা ঘর তুলছেন। অর্থাৎ গুণহীন ছোকরা যার কিছুই হল না, এবং সমাজের মতে, যারা কোন কাজের নয়, তারা যা করে উনি ঠিক তাই করছেন।
তিনি নিজেকে যা ভাবতেন তেমন একটা অসুন্দর লোক, প্রধান কথা, কোন দিক থেকেই উল্লেখযোগ্য নয় এমন একটা মামুলী লোককে রহস্যময়ী মনোরমা কিটি নিজেই ভালোবাসতে পারে না। তা ছাড়া কিটির সাথে তার পূর্বতন সম্পর্ক, ভাইয়ের সাথে বন্ধুত্বের ফলে যেটা ছিল শিশুর প্রতি বয়স্কের সম্পর্কের মত, সেটা তাঁর কাছে মনে হয়েছিল ভালোবাসার পথে আরো একটা নতুন অন্তরায়। তিনি নিজেকে যা ভাবতেন তেমন একটা অসুন্দর সদয় লোককে বন্ধুর মত ভালোবাসা সম্ভব বলে তিনি মনে করতেন, কিন্তু তিনি নিজে কিটিকে যেরকম ভালোবাসতেন, তেমন ভালোবাসা পেতে হলে হওয়া উচিত সুদর্শন, বিশেষ করে অসাধারণ একজন লোক।
তিনি শুনেছেন যে মেয়েরা প্রায়ই অসুন্দর, সাধারণ লোককে ভালোবেসে থাকে, কিন্তু সেটা তিনি বিশ্বাস করতেন না। কেননা নিজেকে দিয়ে বিচার করে দেখলে, উনি নিজে ভালোবাসতে পারেন কেবল সুন্দরী, রহস্যময়ী, অনন্যসাধারণ নারীকে।
কিন্তু গ্রামে একা একা দুমাস কাটিয়ে উনি নিঃসন্দেহ হয়ে উঠলেন যে প্রথম যৌবন যে সব ভালোবাসা তিনি অনুভব করেছিলেন, এটা তারই একটা নয়; এই আবেগ তাকে মুহূর্তের জন্য স্বস্তি দিচ্ছিল না; এই প্রশ্নের মীমাংসা না। করে বাঁচতে পারেন না তিনি; ও আমার বৌ হবে কি হবে না; তাঁর হতাশাটা আসছে শুধু তাঁর এই কল্পনা থেকে যে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করাই হবে এমন কোন প্রমাণ তাঁর কাছে নেই। এবং পাণিপ্রার্থনা করবেন আর গৃহীত হলে বিবাহও করবেন এই দৃঢ় সংকল্প নিয়ে তিনি এবার চলে এলেন মস্কোয়। অথবা…প্রত্যাখ্যাত হলে তার কি হবে সে কথা ভাবতেও পারছিলেন না তিনি।
সাত
লেভিন সকালের ট্রেনে মস্কো এসে ওঠেন তার মায়ের প্রথম স্বামীর ঔরসজাত পুত্র, তার সৎ বড় ভাই সের্গেই ইভানোভিচ কজনিশেভ-এর বাড়িতে; কেন তিনি এসেছেন তখনই তা বলে তার পরামর্শ নেবেন বলে স্থির করে পোশাক বদলে তিনি ঢুকলেন তার স্টাডিতে; কিন্তু বড় ভাই কজনিশেভ একা ছিলেন না। তাঁর কাছে বসে ছিলেন দর্শনের নামকরা এক প্রফেসর। খারক থেকে তিনি এসেছেন বিশেষ করে অতি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক প্রশ্নে তাঁদের মধ্যে মতভেদের মীমাংসা করার উদ্দেশ্যেই। বস্তুবাদের বিরুদ্ধে উত্তপ্ত বিতর্ক চালাচ্ছিলেন প্রফেসর আর সের্গেই ইভানোভিচ কজনিশেভ আগ্রহভরে তা অনুসরণ করে গেছেন; তারপর বিতর্কের শেষ প্রবন্ধটা পড়ে তিনি আপত্তি জানিয়ে প্রফেসরকে চিঠি লেখেন। বস্তুবাদীদের কাছে বড় বেশি ছাড় দেওয়া হয়েছে বলে তিনি প্রফেসরকে ভর্ৎসনা করেন। সাথে সাথেই প্রফেসর চলে আসেন আলোচনার জন্য। প্রসঙ্গটা ছিল একটা চলতি প্রশ্ন নিয়ে মানুষের। ক্রিয়াকলাপে মনস্তাত্তিক আর শারীরবৃত্তীয় ঘটনার মধ্যে সীমারেখা আছে কি, থাকলে সেটা কোথায়?
সকলকেই যে নিরুত্তাপ স্নেহের হাসিতে স্বাগত করতেন কজনিশেভ, ভাইকেও সেভাবে গ্রহণ করে পরিচয় করিয়ে দিলেন প্রফেসরের সাথে, তারপর চালিয়ে গেলেন কথোপকথন।
সরু-কপালে ক্ষুদ্রকায় হলুদ-রঙা চশমা-পরা মানুষটা সম্ভাষণ বিনিময়ের জন্য এক মুহূর্ত আলাপ থামিয়ে আবার। কথাবার্তা চালিয়ে গেলেন, লেভিনের দিকে মন দিলেন না। প্রফেসর কখন চলে যাবেন তার অপেক্ষায় বসে রইলেন লেভিন, কিন্তু অচিরেই আলোচনার প্রসঙ্গে কৌতূহলী হয়ে উঠলেন।
যে সব প্রবন্ধ নিয়ে কথা হচ্ছিল, পত্র-পত্রিকায় লেভিনের তা চোখে পড়েছে, এবং সেগুলো তিনি পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৃতিবিদ্যার ছাত্র হিসেবে প্রকৃতিবিদ্যার যে মূলকথাগুলো তার জানা ছিল তার পরিবিকাশ সম্পর্কে আগ্রহ নিয়ে, কিন্তু জীব হিসেবে মানুষের উদ্ভব, প্রতিবর্ত ক্রিয়া নিয়ে জীববিদ্যা ও সমাজবিদ্যার যুক্তিকে তিনি কখনো জীবন ও মৃত্যুর যা তাৎপর্য সে প্রশ্নের সাথে যুক্ত করেননি যা ইদানীং ঘন ঘন তার মনে উঠছে।
প্রফেসরের সাথে বড় ভাইয়ের কথাবার্তা শুনতে শুনতে লেভিন লক্ষ্য করলেন যে তাঁরা বৈজ্ঞানিক প্রশ্নকে যুক্ত করছেন প্রাণের প্রশ্নের সাথে, বারকয়েক তারা প্রায় এসব প্রশ্নেরই কাছে এসে গিয়েছিলেন, কিন্তু যা তার মনে হচ্ছিল, প্রতিবার যেই তাঁরা সবচেয়ে প্রধান ব্যাপারটার কাছে আসছেন অমনি তারা তাড়াতাড়ি সরে যাচ্ছেন এবং সূক্ষ্ম ভেদাভেদ, কুণ্ঠা জ্ঞাপন, উদ্ধৃতি, ইঙ্গিত, প্রামাণ্যর নজিরের জগতে ডুব দিচ্ছেন, তাদের কথাবার্তা বোঝা তাঁর পক্ষে কঠিন হচ্ছিল।