পালিয়ে যাও, পালিয়ে যাও, পালিয়ে যাও যিশুর কাছে,
পালিয়ে যাও, পালিয়ে যাও ঘর থেকে…
এখানে বেশিদিন থাকার সময় আমার নেই।
এখানে তারা ধর্মের আরেকটি উদ্দেশ্যের উদাহরণ প্রদর্শন করেছিলেন, যারা অসহ্য দুঃখে আছেন তাদের সেই ভাগ্য সহ্য আর খানিকটা মধুর করে তুলতে ধর্মের সান্ত্বনা দেবার ক্ষমতা। ঊনবিংশ শতকের দার্শনিক কার্ল মার্কস, ধর্মের অন্যতম মহান একজন সমালোচক, ধর্মের এই দিকটির স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তিনি পৃথিবী থেকে সব অন্যায় আর অবিচার নির্মল করতে চেয়েছিলেন যা সেই যন্ত্রণার কারণ, যা কিনা ধর্ম প্রশমিত করে। তিনি ধর্মকে ‘জনগণের জন্যে আফিম হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। তিনি এটিকে দেখেছিলেন একধরনের চেতনানাশক হিসাবে। কিন্তু কখনো কখনো সেই সময়গুলো আসে, যখন আমাদের একটি চেতনানাশকের দরকার হয়। আপনি যদি কোনো শল্যচিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যান, আপনি সেই ডাক্তারের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেন যিনি আপনাকে কেটে উন্মুক্ত করার আগে আপনাকে চেতনানাশক ঔষধ দিয়ে অচেতন করে নিয়েছিলেন। ধর্ম সেই ঔষধ হতে পারে যা অস্তিত্বের সেই যন্ত্রণাকে প্রশমিত করতে পারে। শুধুমাত্র অনুদার কোনো মনই সহমর্মিতা প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয় তাদের সাথে, যাদের দুর্দশা এভাবে খানিকটা সহনীয় হয়ে উঠতে পারে। কোনো পাথর-হৃদয়ের কেউ হয়তো উদাসীন হতে পারেন কোনো দাসদের এমন সভা দেখে, যারা তাদের স্বদেশে নিয়ে যাবার জন্য যিশুর দেওয়া প্রতিজ্ঞায় সান্ত্বনা খুঁজে পেতেন।
কিন্তু আফ্রিকান-আমেরিকানরা ইহুদিবাদ-খ্রিস্টান ধর্মের গল্পকে শুধুমাত্র এই একটি উপায়ে ব্যবহার করেননি। তারা আরো সরাসরি রাজনৈতিক কিছু করেছিলেন এর সাথে। তারা এর বার্তাটিকে বিংশ শতাব্দীতে আমেরিকার বর্ণবাদ আর অবিচারের প্রতি তাদের গণআন্দোলনে মন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। তাদের জন্যে আমেরিকা তখনো মিশর এবং তারা তখনো এর বন্দি দাস। তাদের নতুন মোজেস ছিলেন যাজক মার্টিন লুথার কিং, তিনি আবার একজন বৃদ্ধ ফারাওকে তার নিজের মানুষদের মুক্তি দিতে বলেছিলেন।
১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে কিং জর্জিয়ার আটলান্টায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন, দক্ষিণের বর্ণবৈষম্যের কারণে বিভাজ্য রাজ্যগুলোর প্রাণকেন্দ্র ছিল সেটি। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্যাপ্টিস্ট চার্চ, মন্টগোমারি, আলাবামায় একজন যাজক হয়েছিলেন, আর এখান থেকে তিনি আফ্রিকান-আমেরিকানদের জন্যে পূর্ণ নাগরিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামের সূচনা করেছিলেন। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে যেদিন তাকে এক আততায়ী হত্যা করেছিল, সেদিন মার্টিন লুথার কিং নিজের সাথে মোজেসের সদৃশ্যতার কথা বলেছিলেন, যিনি সেই প্রতিশ্রুত দেশটি দূর থেকে দেখেছেন, কিন্তু সেখানে প্রবেশ করার আগে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। আফ্রিকান আমেরিকানরা মিশর থেকে তাদের সেই পলায়নপর্ব শেষ করতে পেরেছিলেন, যখন ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে দাসপ্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়, কিন্তু আরো শতবছর পরেও তারা সেই প্রতিশ্রুত দেশ থেকেই বহু দূরেই ছিলেন, যেখানে তাদের জন্যে থাকবে পূর্ণ সমানাধিকার। আর তার মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পরে তারা এখনো সেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য থেকে বেশ দূরেই অবস্থান করছেন।
এই বইয়ে যেমন প্রায়শই আমরা দেখেছি, ধর্ম শুরু হয় অতিন্দ্রীয় রহস্যময় একটি অভিজ্ঞতা দিয়ে, কিন্তু এটি সবসময়ই রাজনীতিতে প্রবেশ করে। এটি শুরু হয় কোনো অদৃশ্য কণ্ঠ শোনা নবীর হাত ধরে, যারা এর নির্বাচিত উপকরণ। আর তারা যা শোনেন, সবসময়ই সেটি কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালিত করে, যা মানুষের জীবনের ওপর প্রভাব ফেলে : রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে। কখনো এই রাজনীতি খারাপ। মানুষকে ভুল ধর্মবিশ্বাস অথবা ভুল কোনো কণ্ঠ শোনার জন্যে নির্যাতিত হতে হয়। অথবা তাদের বাধ্য করা হয় সেই বার্তাকে গ্রহণ করে নিয়ে যা সম্প্রতি কোনো নতুন নবী ঘোষণা করেছেন। আর সে-কারণে ধর্মের ইতিহাস নানা ধরনের অন্যায় নিপীড়ন নিয়ে একটি অধ্যয়ন।
কিন্তু কখনো রাজনীতি উত্তম। তখন এটি নির্যাতনের নয়, মূলত স্বাধীনতা অস্ত্র। আমরা ভালো রাজনীতি দেখেছিলাম যখন ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে পেনসিলভ্যানিয়ার কোয়েকাররা দাসপ্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। এছাড়া আফ্রিকান আমেরিকান চার্চে খ্রিস্টধর্মের রাজনীতি আজও স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করেই অব্যাহত আছে। এই পৃথিবীকে আরো উত্তম একটি স্থানে পরিণত করতে মোজেসের কৌশল আর যিশুর প্রতিশ্রুতিগুলো ব্যবহার করা হয়। ধর্মকে আর আফিমের মতো অবিচার আর অসমতার সেই দুর্দশার যন্ত্রণা ভোতা করার জন্যে ব্যবহার করা হয়, বরং সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় উত্তেজক হিসাবে এটি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। আর সেটাই এখনো বহু মানুষকে এই ধর্মের খেলায় ধরে রেখেছে।
আর এটি এমন একটি খেলা যা আমেরিকানরা খেলতে ভালোবাসেন। ঊনবিংশ আর বিংশ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্রে কয়েকটি নতুন ধর্মের আবির্ভাব হয়েছিল। পরের অধ্যায়গুলোয় তাদের কয়েকটি নিয়ে আমরা আলোচনা করব।
৩৪. আমেরিকায় জন্ম
আমি এডিনবরায় থাকি এবং হাঁটতে পছন্দ করি। সাধারণত শহরের বাইরে পাহাড়ের দিকেই হাঁটতে বেশি ভালোবাসি, কিন্তু সেটি করার মতো সময় হাতে না-থাকলে আমি আমার বাড়ির আশেপাশের রাস্তাগুলোয় হাঁটি। এই হাঁটার সময় মাসে বেশ কয়েকবার আমার সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসেন কিছু তরুণ। এই কাজগুলো তারা সবসময় জোড়বেঁধে করে থাকেন। সবসময়ই তাদের পরনে থাকে সুন্দর বিজনেস স্যুট, শার্ট আর টাই। আর সবসময়ই তারা বিশেষভাবে বিনয়ী। তাদের বাচনভঙ্গি সবসময়ই আমেরিকান। আর তারা সবসময়ই আমাকে একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। আপনি কি যিশুখ্রিস্ট সম্বন্ধে কিছু জানতে চান? আপনি কি বাইবেল সম্বন্ধে আরো কিছু জানতে চান? আমি সাধারণত ভদ্রভাবে তাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করি এবং হেঁটে চলে যাই। কিন্তু আমি জানি এই এলাকায় হাঁটার সময় আমাকে আবার এই একই প্রশ্ন করে বিরক্ত করা হবে। আমি অবশ্য রাগ করি না। আমি জানি তারা মিশনারি হিসাবে স্কটল্যান্ডে এসেছেন। আমি জানি তারা আমাকে রক্ষা করতে চাইছেন।