লক্ষ করুন স্বর্গ কী ছিল। এটি আকাশের উপর কোনো স্বর্গ নয়, যেখানে তারা অকল্পনীয় সুখ উপভোগ করবেন। এটি ছিল শ্বেতাঙ্গ আগ্রাসনকারীরা এসে ধ্বংস করার আগে তাদের সেই জীবন। সুতরাং তারা নেচেছিলেন। কিন্তু সেই স্বর্গ আর আসেনি। তারা আরো পরিশ্রমের সাথে নেচেছেন। কেউ কেউ তাদের মৃত্যু অবধি। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ মানুষগুলোকে এই পৃথিবী গ্রাস করেনি, তাদের আর তাদের নিষ্ঠুরতাকে মাটি চাপা দেয়নি। বুনো ঘোড়ারা কেশরে সূর্যের আলো মেখে তাদের প্রিয় পাহাড়ের চূড়ায় ঘুরে বেড়ায়নি, বাফেলোরা উত্তর থেকে দল বেঁধে ঝড়ের বেগে নেমে আসেনি, তাদেরকে আহ্বান করেনি পিছু তাড়া করার সেই অভিন্ন উত্তেজনায় অংশগ্রহণ করতে। নিয়তির পরিহাস হচ্ছে, সাম্প্রতিক সংরক্ষণ নীতিমালার কারণে মহাসমতলে বাফেলোরা ফিরে এসেছে ঠিকই, কিন্তু ইন্ডিয়ানরা হারিয়ে গেছে চিরতরে।
মহাপ্রলয়বাদী আন্দোলনগুলো, যেমন, গোস্ট ড্যান্স, সব দুর্দশা আর কষ্ট শেষ হবার আকাঙ্ক্ষায় আর্তনাদ। আর সেই শেষ যে আসেনি, এই বাস্তবতাটি কিন্তু সেই কামনাটি হত্যা করতে পারেনি। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি নির্যাতিত জাতির ধর্মে এটি খুঁজে পাই, আফ্রিকান-আমেরিকান। সমুদ্র অতিক্রম করে বহু। হাজার মাইল দূরের জন্মভূমি থেকে যাদের অপহরণ করে নিয়ে আসা হয়েছিল, যেন তারা তাদের খ্রিস্টান মনিবদের প্রয়োজনে সেবা দিতে পারে। ধর্মের ইতিহাসে নিয়তি বক্রাঘাতগুলোর একটি হচ্ছে যে, দাসরা তাদের মনিবদের কাছ থেকে যে খ্রিস্টান ধর্মবিশ্বাসটি গ্রহণ করেছিলেন, তাদের মনিবদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হতে পারে এর এমন যে-কোনো সংস্করণের চেয়ে সেটি আরো বেশি সত্য আর মূল ধর্মটির নিকটবর্তী ছিল।
দাসদের ধর্ম হিসাবে ইহুদিবাদ শুরু হয়েছিল। যে-কণ্ঠস্বরটি একটি জ্বলন্ত ঝোঁপ থেকে মোজেসের সাথে কথা বলেছিল, সেটি তাকে তার সন্তানদের মিশর থেকে মুক্ত করে প্রতিশ্রুত ভূমিতে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছিল। কীভাবে একজন দাস ‘মালিক’-এর প্রতি সহানুভূতিশীল হতে পারে? কিন্তু কল্পনা করুন, আপনি একজন দাস’ আর এই গল্পটি প্রথমবারের মতো শুনছেন। আপনি কিন্তু আপনার নিজের গল্পই শুনছেন। এটি আপনাকে নিয়েই। আপনি এটি যেভাবে নিজের মধ্যে অনুভব করতে পারবেন, আপনার পিঠে চাবুক কষানো সেই শ্বেতাঙ্গ-মালিকটি তা কখনোই বুঝতে পারবেন না, রোববারে তার নিজের চার্চে তিনি যতসংখ্যক স্তব সংগীতই গান না কেন। ইহুদিবাদ ছিল সেই মানুষদের জন্যে ধর্মবিশ্বাস, যারা দাসত্ব থেকে মুক্তির কামনা করেছিলেন। আফ্রিকান-আমেরিকান দাসরাও সেটি কামনা করেছিলেন। আর তারা সেটিকে তাদের নিজের মতো করে নিয়েছিলেন। এবং তারা সেই বিষয়ে গানও গেয়েছিলেন :
যাও, মোজেস,
মিশরে সেই দেশে তুমি যাও,
বৃদ্ধ ফারাওকে বলো,
আমার মানুষদের যেন সে চলে যেতে দেয়।
.
খ্রিস্টধর্মও শুরু হয়েছিল একটি স্বাধীনতার আন্দোলন হিসাবে। যিশু ছিলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি, যিনি এই পৃথিবীতে এমন একটি রাজত্ব নিয়ে আসবেন, যার মতো আর কোনোকিছুই ইতিহাসে কখনো দেখা যায়নি। এটি শক্তিশালী, ক্ষমতাবানদের তাদের আসনচ্যুত করবে, দরিদ্র আর সাধারণকে সম্মানিত করবে। শোষণ আর নির্যাতনকে এটি ন্যায়বিচার দিয়ে প্রতিস্থাপিত করবে। এটি অসুস্থদের নিরাময় করবে এবং বন্দিদের মুক্তি দেবে। এবং এটি নিয়ে আসবেন একজন মেসিয়াহ, যাকে বেত্রাঘাত করে রক্তাক্ত আর তিরস্কৃত করা হবে, যখন তিনি কালভারি অভিমুখে তার ভারী ক্রুশ বহন করে নিয়ে যাবেন।
এই শব্দগুলো শুনলে, কীভাবে একজন ক্রীতদাস এটিকে তার নিজের পরিস্থিতির একটি বিবরণ হিসাবে অনুভব করতে ব্যর্থ হবেন? তাদের মনিবদের। হয়তো সেই বই আছে যেখান থেকে শব্দগুলো এসেছে, কিন্তু এর অর্থের মূল মালিক ছিলেন তাদেরই দাসরা। খ্রিস্টধর্ম দাসদের জন্য একটি ধর্ম! দাসমালিকরা কীভাবে এটি বুঝতে পারবেন, আর সেই অনুযায়ী জীবন কাটানো তো আরো দূরের ব্যাপার? তাদের বিশেষ সুবিধাপূর্ণ জীবনে প্রতিদিনই এটি তারা অস্বীকার করেছেন। আর দাসরা প্রতিদিনই সেই জীবনটি কাটিয়েছে। তারা জানতেন এই ধর্মটি তাদের। তারা হয়তো এখনো বাইবেল পড়ে উঠতে পারেননি, কিন্তু তারা জানতেন কীভাবে সেই বাইবেল হওয়া যায়। মুক্তির জন্যে এর আকাঙ্ক্ষা ছিল তাদেরই আকাঙ্ক্ষা।
তারপর ভিন্ন কিছু ঘটতে শুরু করেছিল, যেভাবে তারা সেটি ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন। বাইবেল তাদের স্বাধীন হবার আকাঙ্ক্ষার গান গেয়েছিল নিশ্চয়ই, এটি তাদের সেই ইচ্ছার প্রতিধ্বনি করেছিল, যে ইচ্ছা তাদের তখনো পূরণ হয়নি, হয়তো কখনোই পূরণ হবে না। কিন্তু তারা সেটি তাদের উপাসনায় ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন এমন একটি উপায়ে, তাদের বন্দি করে রাখা কাঠামোর মধ্যেই একধরনের স্বাধীনতা দিয়েছিল। তাদের যাজকরা শুধুমাত্র বাইবেলের গল্পগুলো নিয়েই ‘কথা’ বলেননি। তারা সেগুলোকে ‘বর্তমান’রূপে উপস্থাপন করেছিল, এগুলো এমন একটি উপায়ে তারা বাস্তব করে তুলেছিলেন, তাদের শ্রোতারা সেই গল্পে প্রবেশ ও অনুভব করতে পেরেছিলেন। আর সেটি করার মাধ্যমে তারা আমেরিকার শিল্পকলার শ্রেষ্ঠতম অভিব্যক্তিগুলোর একটি আবিষ্কার করেছিলেন। তাদের দুঃখ নিয়ে সংগীত নির্মাণের একটি উপায়, যা সেইসব দুঃখকে ম্লান করে দিয়েছিল, যা ছিল এই গানগুলোরই বিষয় –যদিও শুধুমাত্র এক বা দুই ঘণ্টার জন্য, দক্ষিণের কোনো খামারের কুটিরে কোনো রোববার সন্ধ্যায়। তারা চাবুক আর তিরস্কার থেকে পালিয়ে একটি পরমানন্দে প্রবেশ করতেন, যা তাদের অন্য একটি জগতে নিয়ে যেত।