এই আবিষ্কার হওয়াটি ‘ইন্ডিয়ান’ অর্থাৎ সেখানে বহু হাজার বছর ধরে বসবাসরত সেই আদিবাসীদের জন্যে খুব ভয়ংকর একটি বিপর্যয় ছিল। পরবর্তী চারশো বছরে শ্বেতাঙ্গ বসতিস্থাপনকারীরা তাদের পুরো দেশটি দখল করে নিয়েছিল এবং খ্রিস্টধর্মের বহু প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্করণ দিয়ে তারা এটি পুরোটাই আবৃত করেছিল। ধর্ম অনেক উদ্দেশ্যপূরণে ব্যবহৃত হয়, কিছু নিষ্ঠুর আর কিছু ক্ষতিকর নয়। এর সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম কাজটি হচ্ছে অন্য কোনো জাতিকে প্রতিস্থাপন এবং নিজস্ব বাসভূমি থেকে তাদের উচ্ছেদ করার ভয়ংকর অমানবিক কাজটির ন্যায্যতা প্রতিপাদন করা। যেভাবে ইজরায়েলাইটরা প্যালেস্টাইনে তাদের প্রতিশ্রুত দেশ দখল করেছিল, নতুন ‘পাইওনিয়ার’ বা ঔপনিবেশিকরা, যারা উত্তর-আমেরিকার পশ্চিমদিক বরাবর ক্রমশ তাদের উপনিবেশের সীমানা অগ্রসর করছিলেন, তারা বিশ্বাস করেছিলেন, এমন কিছু করাটাই তাদের ঈশ্বর-নির্দেশিত নিয়তি। যে প্রটেস্টান্টবাদ তারা সাথে নিয়ে এসেছিলেন সেটি খুবই অস্থির একটি ধর্ম ছিল, যা আমেরিকার ওপর এর বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে। এটি আসক্তি দ্বারা পরিচালিত একটি সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছিল, যা চিরন্তনভাবেই অসন্তুষ্ট আর নিরন্তরভাবে উচ্চাভিলাষী। জয় করার জন্যে সবসময়ই তারা নতুন সীমানা আবিষ্কার করা অব্যাহত রেখেছিল।
কিন্তু যে-দেশটি এই আগ্রাসনকারীরা দখল করেছিলেন সেটি ধর্মীয় কোনো শূন্যস্থান ছিল না। এর আদি বাসিন্দাদের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী আধ্যাত্মিক নানা আচার ছিল, যা সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল ভিনদেশিদের নিয়ে আসা চঞ্চল প্রটেস্টান্টবাদ থেকে, যে-ধর্মটি তাদের আক্রমণ করেছিল। আদিবাসী আমেরিকানরা প্রকৃতির বিরুদ্ধে নয় বরং এটিকে অনুসরণ করেই তাদের জীবন কাটাতেন। যে-দেশটি তাদের লালন করেছিল, সেই দেশটির ভূমি আর প্রকৃতির সাথে তাদের পবিত্র একটি সম্পর্ক ছিল। তারা বিশ্বাস করতেন একটি গ্রেট স্পিরিট বা মহান আত্মা এর মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করেছে। আর এই ‘গ্রেট স্পিরিট’ শব্দটি হচ্ছে তাদের জন্যে ‘ঈশ্বর’ শব্দটির সমার্থক। এটি বিশেষভাবে সত্য ছিল ঘোড়সওয়ার সেই গোত্রগুলোর জন্যে, যারা মহাদেশটির ঠিক কেন্দ্রে অবস্থিত বিস্তৃত সমতলে বাস করতেন, যা পরিচিত ‘গ্রেট প্লেইনস’ নামে। তিন হাজার মাইল দীর্ঘ আর প্রায় সাতশো মাইল প্রশস্ত এই বিশাল সমতল ভূমিটি উত্তরে কানাডা থেকে দক্ষিণে মেক্সিকো অবধি প্রায় এক মিলিয়ন বর্গমাইল জুড়ে বিস্তৃত ছিল।
আর এখানে ঘুরে বেড়াত অগণিত বাফেলো’র (উত্তর-আমেরিকার বাইসন) পাল, এখানে বসবাসকারী মানুষগুলোর–যাদের সাথে এই বিশাল ভূমি বসবাসের জন্য বাফেলোরা ভাগ করে নিয়েছিল –সব চাহিদা এটি পূরণ করত। এই আদিবাসীরা তাদের প্রকৃতিতে যাযাবর ছিলেন এবং বাফেলোর সাথে তাদের সম্পর্কটিকে তারা দেখতেন একধরনের কমিউনিয়ন বা অভিন্ন একটি ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে। তারা খুব সংযম আর পরিমিতিবোধের সাথেই এই পৃথিবীতে তাদের জীবন ধারণ করতেন। এবং যদিও ‘দ্য গ্রেট স্পিরিট’ সম্বন্ধে জানা, এটি সংজ্ঞায়িত বা নিয়ন্ত্রণ করার খুব সামান্যই ইচ্ছা ছিল তাদের, তবে তারা এর রহস্যময়তা আর আধ্যাত্মিক সিদ্ধিলাভ করার যে অনুভূতির অভিজ্ঞতা এটি তাদের মনে জাগিয়ে তুলত, সেটির প্রতি সম্পূর্ণভাবেই নিজেদের উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। তাদেরও নবীরা ছিলেন, যারা মাঝে দৈবদৃশ্যের সন্ধানে অভিযানে যেতেন, মাদক আর আত্মক্ষত সৃষ্টি করার আচার-ব্যবহার করতেন এর শক্তির প্রতি তাদের নিজেদের উন্মুক্ত করতে। এবং তারা আবার তাদের গোত্রের মানুষদের কাছে ফিরে আসতেন, গ্রেট স্পিরিটের সাথে সংযোগ করার সময় তাদের যে অভিজ্ঞতাগুলো হয়েছিল, তারা মন্ত্র আর নাচের মাধ্যমে তার পুনরাবৃত্তি করতেন।
কিন্তু এটিকে একটি ‘ধর্ম’ হিসাবে দেখলে ভুল হবে, এমন কিছু যা-কিনা ‘ফেইথ’ বা ধর্মবিশ্বাস নামের একটি অংশ তাদের জীবনের বাকি অংশ থেকে পৃথক করে রেখেছে। সেই অর্থে তাদের কোনো ধর্ম নেই। তারা নিজেদেরকে জীবন্ত একটি রহস্য দিয়ে পরিবেষ্টিত ভাবতেন, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল তাদের পরিচিত এই পৃথিবী, বাফেলোদের পাল এবং সেই বাতাসও, যা সমতলের ঘাসগুলো আন্দোলিত করত। এটি যেমন ভঙ্গুর, তেমনি পলায়নপর; এটি টিকে থাকতে পারেনি সেখানে ইউরোপীয় বসতিস্থাপনকারীদের আগ্রাসন আর ব্যাপকভাবে বাফেলো-হত্যার কারণে, আদিবাসীদের অভুক্ত রেখে পিছু হটানোর। জন্যে যে-কৌশলটি উপনিবেশস্থাপনকারীরা পরিকল্পিতভাবে গ্রহণ করেছিলেন। তারা এইসব শুদ্ধিবাদী পিউরিটানদের মতো ছিলেন না, যারা তাদের ধর্মবিশ্বাসের জন্য নিজেদের দেশ ইংল্যান্ডে নির্যাতিত হয়েছিলেন, কিন্তু সেই ধর্মবিশ্বাসটি তারা সাথে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন, যখন তারা আটলান্টিক মহাসাগর অতিক্রম করেছিলেন। সমতলের ইন্ডিয়ানদের যখন তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল, এবং যখন তারা দেখেছিলেন যে, বাফেলো বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছে। শিকার করে, তারা সবকিছুই হারিয়েছিলেন।
তাদের এই ট্র্যাজেডি মহাপ্রলয়বাদী উন্মাদনার প্রাদুর্ভাব প্ররোচিত করেছিল, যা স্মরণ করা খুবই হৃদয়বিদারক। প্রলয়বাদী আন্দোলনগুলো সাধারণত ক্রমশ দানা বাঁধে শোষিত মানুষের মধ্যে, দীর্ঘ সময় ধরে ঈশ্বর তাদের যন্ত্রণা উপেক্ষা করতে পারেন সেটি আর যারা আর বিশ্বাস করতে পারেন না। সুতরাং তারা সেই। স্বপ্নগুলো দেখেন, আবার নতুন করে সব শুরু হবে। অধিকারচ্যুত ইন্ডিয়ানদের মধ্যে ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে একটি আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল যার নাম ছিল ‘গোস্ট ড্যান্সিং’। যে নবী এটি ঘোষণা করেছিলেন, তিনি তাদের বলেছিলেন তারা যদি তার কথামতো চলেন, দীর্ঘ এবং অনেক কঠোর পরিশ্রম করে নাচেন, তাহলে শ্বেতাঙ্গরা চিরকালের জন্যে নতুন মাটির গভীর স্তরের তলে হারিয়ে যাবে। সব চলে যাবে! আগ্রাসনকারীরা ধ্বংস হবে। তারপর আবার বন্য ঘোড়া আর বাফেলোর পাল সমতলে ফিরে আসবে মর্মরধ্বনি করা ঘাসের মধ্যে। এবং সব ইন্ডিয়ানরা যারা কখনো জীবিত ছিলেন তারা সবাই জীবনে ফিরে আসবেন এবং এই স্বর্গে তাদের সাথে বাস করবেন।