১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ, খ্রিস্টানদের সম্ভবত মনে হয়েছিল যে, যিশু আর ফিরে আসেননি, এবং দেখে মনে হচ্ছে খুব শীঘ্রই তার ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনাও নেই। পৃথিবীর শেষদিনে ঈশ্বর এসে সব ঠিক করে দেবেন, এমন আশায় অর্থহীন অপেক্ষায় কালক্ষেপণ না করে, পৃথিবীর সব অশুভ বিষয়গুলোর সমাধান করার নিশ্চয় এখনই সবচেয়ে ভালো সময়। শুধু এর ব্যতিক্রম ছিল দাসপ্রথার বিষয়টি, কারণ সেখানে কিছু সমস্যা আছে। বাইবেল ঈশ্বরের সেই কণ্ঠস্বর লিপিবদ্ধ করেছিল, যা মোজেসকে বলেছিল এই বিষয়ে :
যখন তুমি একজন হিব্রুদাস ক্রয় করবে, ছয় বছর সে তোমার সেবা করবে, কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়াই সপ্তম বছরে তাকে মুক্তি দিতে হবে। যদি সে একা তোমার কাছে এসে থাকে, তাহলে সে একাই তোমার কাছ থেকে চলে যাবে। আর যদি সে বিবাহিত হয়, তার স্ত্রীও তার সাথে যাবে। যদি তার মালিক তাকে স্ত্রী দিয়ে থাকে, এবং সে তার জন্যে পুত্র বা কন্যার জন্ম দিয়ে থাকে। তাহলে সেই স্ত্রী আর সন্তানরা তাদের মনিবেরই থাকবে।
আর পল তার লেটার টু চার্চ ইন এফেসুস’ চিঠিতে খ্রিস্টান দাসদের তাদের পার্থিব মনিবের অনুগত হতে উপদেশ দিয়েছিলেন, ‘ঠিক যেমন তারা স্বয়ং যিশুর অনুগত’।
সুতরাং বাইবেলে বিষয়টি খুব সুস্পষ্ট। আর বাইবেলের কথা চ্যালেঞ্জ করার তারা কে? বেশ, ১৬৮৮ সালে পেনসিলভানিয়ার কোয়েকাররা এটি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। আর যেভাবে তারা সেটি করেছিলেন, সেটি ভবিষ্যতে খ্রিস্টানরা কীভাবে বাইবেল পড়বে, তার ওপর একটি বৈপ্লবিক প্রভাব ফেলেছিল। কোয়েকাররা অভ্যন্তরীণ আলোর কর্তৃত্বে বিশ্বাস করতেন, যাকে আমরা বলতে পারি বিবেক। তারা জানতেন এই আলোই তাদের নির্দেশনা দিচ্ছে, দাসপ্রথা পুরোপুরিভাবেই অন্যায়। যদি সব মানুষের সমান মূল্য থাকে, তাহলে কাউকে অপেক্ষাকৃত কম মানুষ বা ঈশ্বরের সন্তান নয় বরং সম্পত্তি বা পণ্য হিসাবে বিবেচনা করা অবশ্যই ভুল। আর যদি বাইবেল অন্য কথা বলে থাকে তাহলে বাইবেলই ভুল।
বাইবেলে দাসপ্রথা যুক্তিযুক্ত করার বিষয়টির প্রতিবাদ করা ছাড়াও কোয়েকাররা আরো অনেককিছুই করেছিলেন। দাসপ্রথাকে বিলোপ করার প্রচেষ্টায় তাদের পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব ছিল ততটুকই তারা করেছিলেন। তারা এটি পেনসিলভানিয়ায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, এছাড়া একটি গোপন পথ বা ‘আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোড’ সংগঠিত করেছিলেন, যা দক্ষিণ থেকে পালিয়ে আসা ক্রীতদাসদের উত্তর বা কানাডায় স্বাধীনভাবে বাস করার সুযোগ খুঁজতে সহায়তা করেছিল। তথাকথিত খ্রিস্টীয় সমাজে দাসপ্রথার অস্তিত্বের বিরুদ্ধে কোয়েকারদের তীব্র বিরোধিতা এবং প্রতিবাদে তাল মেলাতে বাকি পৃথিবীর অনেক দিন সময় লেগেছিল। পুরো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে এটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হতে ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এবং ত্রিশ বছর পরে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে একটি রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের পর, এটি আমেরিকায় নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল।
কিন্তু এই জঘন্য দাসপ্রথার বিলোপ সূচনা করা ছাড়াও কোয়েকাররা আরো অনেক কিছু করেছিলেন। তারা অগভীর আর শিশুসুলভ উপায়ে বাইবেল পাঠ করার পদ্ধতির অবসান ঘটিয়েছিলেন। বাইবেলের শিক্ষার বিরুদ্ধে তাদের নিজেদের বিবেকের সিদ্ধান্তের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করার মাধ্যমে তারা অস্পৃশ্য কোনো স্বর্গীয়। প্রতিমা নয় বরং অন্য যে-কোনো একটি বইয়ের মতো বাইবেল পাঠ করার। বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন। কোনটি সঠিক’ আর বাইবেল কোনটিকে বলছে ‘সঠিক’–এই দুটির মধ্যে পার্থক্য কী তারা জানতেন। আর যেহেতু তারা বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর নিজেই তাদের এই পার্থক্য সম্বন্ধে সতর্ক করে দিয়েছেন, এটি প্রমাণ করে যে, এমনকি বাইবেলের বিষয়ে ঈশ্বরেরও কিছু আপত্তি আছে! আর যদি বাইবেলে দাসপ্রথার ব্যাপারে ভুল হয়ে থাকে, তাহলে কি এটি ছয়দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করার ব্যাপারে ভুল হতে পারে না? হয়তো বহু শতাব্দী ধরে আমরা এই বইটিকে ভুলভাবে পড়ছি। হয়তো নতুন করে এটি ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে। আরো আরো বুদ্ধিমত্তার সাথে এটি আমাদের পড়তে হবে। হয়তো বাইবেলের কিছু নির্দেশনা আর বিচারিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে নিজেদের বিবেকের নির্দেশনাগুলো আরো দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের ভয় পাওয়া উচিত নয়।
আর এইসব নানা উপায়ে কোয়েকাররা সেই ধাক্কাটি দিয়েছিলেন, যাকে আমরা বলি ধর্মশাস্ত্রের ‘ঐতিহাসিক-সমালোচনামূলক পাঠ। আবশ্যিকভাবে এটি বাইবেলের ওপর থেকে ঈশ্বরের প্রভাবটিকে বাতিল করছে না, কিন্তু এটি স্বর্গীয়। থেকে মানবিক উপাদানগুলোকে পৃথক করতে চেষ্টা করেছে। দাসপ্রথা একটি মানবিক আবিষ্কার। আপনার প্রতিবেশীকে নিজের মতোই ভালোবাসুন, এটি স্বর্গীয় নির্দেশ! বেশ, তাহলে বিষয়টি ভেবে দেখুন, এই নির্দেশনার আলোকে কোন্টি সত্য হবে?
‘দ্য সোসাইটি অব ফ্রেন্ডস’ হয়তো পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম ধর্মবিশ্বাসী গোষ্ঠীগুলোর একটি হতে পারে, কিন্তু তাদের প্রভাব ছিল অনেক বিশাল। এটি এখনো খ্রিস্টধর্মের বিবেক হিসাবে তার নিজের অবস্থানটি ধরে রেখেছে। এটি আমেরিকায় খ্রিস্টধর্মের নতুন আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা আহ্বানকারী একটি সংস্করণ নিয়ে এসেছিল। কিন্তু খ্রিস্টধর্ম সেখানে পৌঁছাবার আগেই আমেরিকায় নিজস্ব একটি আধ্যাত্মিকতা ছিল। সেটি পরীক্ষা করে দেখার এবার সময় এসেছে।
৩৩. আমেরিকায় তৈরি
১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন। এই বাক্যটি প্রস্তাব করছে যে, তিনি এটি খুঁজে না-পাওয়ার আগে কেউ জানত না এমন একটি মহাদেশের অস্তিত্ব আছে। এর অস্তিত্ব সম্বন্ধে ইউরোপের অধিবাসীরা অবশ্যই কিছু জানতেন না। যখন সেই ঐতিহাসিক সমুদ্র-অভিযানে তিনি বের হয়েছিলেন, কলম্বাস ইন্ডিয়া বা ভারত যাবার একটি রাস্তা খুঁজছিলেন। তিনি জানতেন ইউরোপের পূর্বে, আফ্রিকার দক্ষিণতম প্রান্ত ঘুরে ঘুরে একটি দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার শেষে ইন্ডিয়ার অবস্থান। কিন্তু তিনি আশা করেছিলেন, যদি পশ্চিমে আরো বহুদূরে যাওয়া যায়, তাহলে সেখানে পৌঁছানোর অন্য একটি দ্রুততর আর সহজ পথ তিনি হয়তো আবিষ্কার করতে পারবেন। আর যখন তিনি নতুন এই পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছিলেন, তিনি ভেবেছিলেন, তিনি ইন্ডিয়ায় এসে পড়েছেন। সুতরাং তিনি স্থানীয় অধিবাসীদের নাম দিয়েছিলেন ইন্ডিয়ান, যে নামটি এখনো এই এলাকার আদিবাসীদের সাথে যুক্ত হয়ে আছে।