হিন্দুধর্মে এটিকে কার্মা অথবা কর্মের সূত্র (ল অব ডিড) বলা হয়। কিন্তু এটির ব্যাপ্তি শুধুমাত্র এই জীবনটি নয় যা আপনি এখন যাপন করছেন। হিন্দুধর্মের শিক্ষানুয়ায়ী, আপনার আত্মা এই মুহূর্তে যে-জীবনটি আপনি কাটাচ্ছেন, সেটিতে আসার আগে, অতীতে আরো বহু জীবন কাটিয়ে এসেছে। আর এই জীবনটি শেষ হবার পরে ভবিষ্যতে আপনি আরো বহু জীবন কাটাবেন। এই জীবনগুলো প্রত্যেকটি নির্ধারিত হয় কীভাবে আপনি এর আগের জীবনটি কাটিয়েছেন তার ওপর, এবং সেটি নির্ভর করবে এরও আগের জীবন এবং সেই জীবনের আগের জীবন কেমন কাটিয়েছিলেন তার ওপর। এভাবে বহুদূর একটি অতীতের অস্পষ্টতায় যা বিস্তৃত হয়ে আছে। ঠিক এখন যেভাবে আপনি আচরণ করছেন সেটি জীবনের চাকার পরবর্তী ঘূর্ণনে আপনি কেমন জীবন পাবেন সেটিকে প্রভাবিত করবে।
যখন ভারতের নবী আর প্রাজ্ঞ সাধুরা দূরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, এবং মানুষ যখন মারা যায় তাদের সাথে কী ঘটে সেই বিষয়ে ভেবেছিলেন, তারা একটি আকর্ষণীয় উত্তর পেয়েছিলেন। মানুষ আসলে মরে না, সেই অর্থে যে সম্পূর্ণভাবে তাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়, অথবা সেই অর্থে যে তারা মৃত্যুর পরে অন্য কোনো একধরনের জীবন কাটানো অব্যাহত রাখেন। না, তারা পৃথিবীতেই আবার ফিরে আসেন অন্য কোনো জীবনের রূপে, যে রূপটি কী হবে তা নির্দেশ করে তাদের অতীত সব জীবনের কার্মা। আর সেই জীবনটি মানুষ হিসাবে নাও হতে পারে। পুরো অস্তিত্বটাই এখানে একটি বিশাল রিসাইক্লিং বা পুনর্ব্যবহৃত হবার কারখানা, যেখানে জীবনের গুণগতমান, যা ‘মৃত্যু’ চিহ্নিত দরজা দিয়ে অতিক্রম করে, সেটি ‘পুনর্জন্ম’ নামে চিহ্নিত দরজার অন্যদিক থেকে বের হয়ে আসা জীবনের রূপ ও গুণগত মানকে প্রভাবিত করে। আর এই কারখানাটির নাম হচ্ছে ‘সামসারা’ (সংসার, জন্ম-মৃত্যু-পুনর্জন্মের চক্র, মানে এই চক্রের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করা), কারণ আত্মাগুলো এর মধ্যদিয়ে বাহিত হয়ে তাদের পরবর্তী এবং তার পরবর্তী (এবং পরবর্তী…) রূপগুলো পায়। ভালো কিংবা খারাপ, প্রতিটি কর্ম যা তারা একটি জীবনে করেছিলেন, সেগুলো তাদের পরবর্তী জীবনগুলোর গুণগত মানটিকে প্রভাবিত করে। আর শুধুমাত্র মানুষ প্রাণীরাই এই সামসারার চক্রে আটকে পড়ে নেই। পুরো পৃথিবীটা নিজেই মৃত্যু আর পুনর্জন্মের একই আইন মেনে চলে। এই অস্তিত্বের বর্তমান চক্রটি শেষে, এটি একটি বিশ্রামপর্বে প্রবেশ করবে, যেখান থেকে সময় হলে আবার এটিকে ডেকে নিয়ে আসা হবে অস্তিত্বের ভিন্ন একটি রূপে। সুতরাং অস্তিত্বের এই চাকাটি বিরতিহীনভাবেই ঘূর্ণায়মান।
কিন্তু এই কার্মাকে (বা কর্ম : কাজ, অভিপ্রায় ও ফল) তারা অতিপ্রাকৃত কোনো আত্মা-পরিদর্শকের পরিকল্পিত শাস্তি হিসাবে মনে করেন না। কার্মা মাধ্যাকর্ষণের সূত্রের মতো নৈর্ব্যক্তিক একটি আইন, যেখানে কোনো একটি জিনিস আরেক জিনিস থেকে আসে, যেভাবে কোনো ফলাফল কারণ অনুসরণ করে। যেমন, একটির-পর-একটি সাজানো ইটের প্রথমটিকে স্পর্শ করে ধাক্কা দিলে দেখা যায় একটার-পর-একটা সবগুলো ইটই পড়ে যাচ্ছে। ‘সামসারা’র মধ্যে দিয়ে এর যাত্রায় আত্মাকে হয়তো এমনকি আট মিলিয়ন সংখ্যক বার জীবনের রূপে আবির্ভূত হতে হয় অবশেষ-এর মোক্ষ অর্জন করার পূর্বে।
মৃত্যুর পর আমাদের সাথে কী ঘটে, সেটির এই বিবরণটির ধর্মীয় পরিভাষায় নাম হচ্ছে ‘রিইনকারনেশন’ বা পুনর্জন্ম। সারা পৃথিবীজুড়েই বহু সমাজেই এটি বিশ্বাস করে আসা হচ্ছে, তবে ভারতে হিন্দুধর্মের মতো আর কোথাও এটি এত তীব্রতা অর্জন করতে পারেনি। এটিকে ব্যাখ্যা করতে যেসব শব্দ আমি ব্যবহার করেছি, কার্মা, কাজের সূত্র, ‘সামসারা’, ‘মোক্ষ’ বা মুক্তির অনুসন্ধানে জন্ম জন্মান্তরের আত্মার পরিভ্রমণ, সব এসেছে সংস্কৃত নামক একটি প্রাচীন ভাষা থেকে। এই ভাষাটিকে ভারতে নিয়ে এসেছিল উত্তর থেকে আসা একদল বন্য আগ্রাসনকারী। কমন এরা শুরু হবার প্রায় দুই হাজার বছর আগে (খ্রিস্টপূর্ব) ভারতে তাদের আবির্ভাবে সাথে আমরা হিন্দুধর্মের সূচনাপর্বটির সময় নির্ধারণ করতে পারি।
ভারতের উপরে বহু দূর-উত্তরে তৃণভূমির বিস্তৃত একটি ভৌগোলিক এলাকা আছে, যাদের বলা হয় মধ্য-এশীয় স্টেপস। এটি মৃত, রুক্ষ, বৃক্ষহীন, তৃণাবৃত, সুবিস্তীর্ণ সমতল একটি এলাকা, ঘোড়সওয়ার কাউবয়দের জন্যে আদর্শ, যারা তাদের গবাদি পশুর পালের জন্যে সেরা চারণভূমির সন্ধানে চিরব্যস্ত। নিশ্চিত নয় এমন কিছু কারণে কমন এরা শুরু হবার আগের দ্বিতীয় সহস্রাব্দে, আরো উত্তম একটি জীবন খুঁজে পাবার প্রত্যাশায় মানুষ এই স্টেপস থেকে দক্ষিণে অভিযাত্রা করতে শুরু করেছিল। তাদের অনেকেই আরো দক্ষিণে ভারতে প্রবেশ করেছিল। তারা তাদের নিজেদের স্বদেশবাসী/স্বদেশি বা স্বজাতি বলতেন, তাদের নিজেদের ভাষায়, ‘আর্য’। তারা যুদ্ধপ্রিয় একটি জাতি ছিল, দ্রুতগামী রথ পরিচালনা করতেন; উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম কোণে সিন্ধুনদের উপত্যকায় দলবেঁধে ঢেউয়ের মতো তারা প্রবেশ করেছিলেন।
ইতিমধ্যেই সেখানে একটি উন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব তখন ছিল, যে সভ্যতাটির অগ্রসর পর্যায়ের শিল্পকলা, স্থাপত্য আর ধর্মের একটি কাঠামো ছিল। আর উন্নত সমাজের মতোই এটিরও যেমন সদগুণাবলি ছিল, তেমন অনাচারও ছিল। আর এরকম একটি দৃশ্যে এই আর্য আগ্রাসনকারীরা তাদের ঘোড়ায় চড়ে হাজির হয়েছিলেন, তাদের সূক্ষ্ম পরিশীলতায় যে ঘাটতি ছিল, শক্তি আর সাহস দিয়ে তারা সেই ঘাটতিটি পুষিয়ে নিয়েছিল। আরেকটি বিষয় যা স্থানীয়দের থেকে আগ্রাসীদের পৃথক করেছিল, সেটি হচ্ছে তার চামড়ার রং ছিল হালকা, আর সেই চামড়ার রঙের পার্থক্যের মধ্য বহু ইঙ্গিত প্রবেশ করেছিল, যা এখনো আমাদের এই সময় অবধি প্রতিধ্বনিত্ব হচ্ছে, যা সেই আর্য শব্দটিকে একটি কুৎসিত অর্থ। দিয়েছে। কিন্তু এই আগ্রাসীরা তাদের হালকা রঙের চামড়া ছাড়াও আরো কিছু সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। তাদের দেবদেবীদেরও তারা সাথে নিয়ে এসেছিলেন। এছাড়াও এনেছিলেন বিস্ময়কর ব্যাপ্তির একটি ধর্মীয় সাহিত্যকর্মের সূচনা– যার নাম ‘বেদ’।