আসুন আবার মোজেসের গল্পে ফেরা যাক, এবং এই মরুভূমির অভিজ্ঞতাটির বিবরণে তার দিকটির প্রতি মনোযোগ দিই। আপনার দৃষ্টিতে ঝোঁপটি যেমন আগুনে জ্বলন্ত ছিল না, তেমনি আপনি সেখান থেকে বের হয়ে আসা ঈশ্বরের গম্ভীর গলার স্বরও শুনতে পারেননি। কিন্তু তাহলে মোজেস কীভাবে সেখান থেকে আগুনের শিখার তাপ অনুভব করেছিলেন এবং এত গভীর মনোযোগের সাথে তাকে কিছু করতে নির্দেশ দেওয়া সেই কণ্ঠস্বর শুনেছিলেন, এবং সেই নির্দেশ তিনি মান্য করছিলেন? তাহলে কি এটি শুধুমাত্র তার মস্তিষ্কের মধ্যে ঘটেছিল, যে কারণে সেখানে কী ঘটছে সেটি আপনি দেখতে পারেননি? অথবা, তার মন কি অন্য কোনো মনের সংস্পর্শে এসেছে যা আপনার ইন্দ্রিয়গুলোর বোঝার সীমানার বাইরে? যদি ধর্মের সূচনা হয়ে থাকে সাধু ও নবীদের মনের অভিজ্ঞতাগুলো দিয়ে, আপনি যদি তাদেরকে নিরপেক্ষভাবে বিচার করেন এবং কল্পনা হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের বাতিল করে না দেন, তাহলে আপনাকে বিবেচনা করতে হবে কিছু মানুষ কি সেই বাস্তবতাগুলোর প্রতি বেশি উন্মুক্ত কিনা, আমরা বাকিরা যার প্রতি অন্ধ এবং বধির।
একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হচ্ছে, আমাদের মন দুটি ভিন্ন স্তরে কাজ করে, যেমন, একতলা কোনো বাড়ির মতো, যেখানে নিচে একটি বেসমেন্ট অথবা সেলার থাকবে। যখন স্বপ্ন দেখি, আমরা সেই পার্থক্যটির অভিজ্ঞতা অনুভব করি। দিনের বেলায় সচেতন মন উপরতলায় জেগে আছে, এটি তার পরিকল্পিত সুশৃঙ্খল জীবন কাটায়। কিন্তু যখনই আলো নিভিয়ে ফেলা হয় আর আমরা রাতে ঘুমাতে যাই, নিচের তলার সেলারের দরজা খুলে যায়, আমাদের স্বপ্ন-দেখা মনকে এলোমেলো অসংলগ্ন নানা অপ্রকাশিত কামনা আর ভুলে যাওয়া আতঙ্ক দিয়ে পূর্ণ করে। সুতরাং যদি আমরা আপাতত সেই প্রশ্নটি একপাশে সরিয়ে রাখি, আমরা যা-কিছু চোখে দেখি তারচেয়ে আরো অন্য কোনো মহাবিশ্ব আছে কিনা, আমরা অন্তত স্বীকার করব যে আমাদের জীবনে, নিয়মিত, জেগে-থাকা সময়গুলো ছাড়াও আরো কিছু আছে। মানবমনের মাটির নিচে একটি বেসমন্টের মতো আছে যাকে বলা হয় সাবকনশাস বা অবচেতন এবং যখন আমরা ঘুমাই, এর দরজা খুলে যায় এবং সেই দরজা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে বহু চিত্র আর কণ্ঠস্বর, যাদের আমরা স্বপ্ন বলি।
ধর্মের ইতিহাসে আমরা সেই মানুষগুলোকে খুঁজে পাব, যারা জাগ্রত অবস্থায় এ-ধরনের সাক্ষাতের মুখোমুখি হয়ে থাকেন, যা বাকি আমরা শুধু স্বপ্নেই দেখতে পাই। আমরা তাদের নবী (প্রফেট) আর স্বপ্নদ্রষ্টা বলি। কিন্তু অন্য একটি উপায় হচ্ছে, সৃজনশীল শিল্পী হিসাবে তাদেরকে ভাবা, যারা চিত্রকর্ম উপন্যাসে তাদের সেই অভিজ্ঞতাগুলো ব্যক্ত না করে বরং বাধ্য হন সেগুলোকে বার্তায় অনুবাদ করতে, যা বহু মিলিয়ন মানুষকে তারা যা-কিছু দেখেছেন আর শুনেছেন সেটি বিশ্বাস করতে প্ররোচিত করেন। আর এই রহস্যময় কার্যকলাপের সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণটি ছিলেন মোজেস। কোনোকিছু তার সংস্পর্শে এসেছিল কোনো-না-কোনো একটি জায়গা থেকে, আর ইতিহাসে সেই সাক্ষাতের ঘটনাটি ইহুদি জনগোষ্ঠীর জীবন চিরকালের জন্যে বদলে দিয়েছিল। কিন্তু সেই কিছুটা কী ছিল আর সেটি কোথা থেকে এসেছিল? এটি কি তার ভিতরে ছিল? নাকি তার বাইরে ছিল? অথবা একই সাথে কি সেটি ঘটতে পারে?
সাইনাই মরুভূমিতে মোজেসের সাথে যা ঘটেছিল, সেটিকে একটি উদাহরণ হিসাবে নিয়ে এবং সচেতন আর অবচেতন মনের মধ্যে দরজার রূপকটি আমাদের বোঝার সুবিধার্থে ব্যবহার করে, আমি একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রস্তাব করছি, যা ধর্মীয় অভিজ্ঞতা নিয়ে চিন্তা করতে তিনটি ভিন্ন উপায় উপস্থাপন করে।
এই ধরনের কোনো ঘটনায়, অবচেতন আর সচেতন মনের মধ্যবর্তী দরজাটি খুলে যায়। এরপর যা ঘটে সেটি স্বপ্নের মতো। নবীরা বিশ্বাস করতেন এটি আসছে তাদের বাইরে থেকে, কিন্তু এটি আসলে তাদের নিজেদের অবচেতন মন থেকে এসেছিল। যে কণ্ঠস্বর তারা শোনেন, সেটি সত্য। এটি তাদের সাথে কথা বলে। কিন্তু এটি তাদের নিজেদেরই কণ্ঠ, যা তাদের নিজেদের মনের মধ্যে থেকে আসছে। আর সে-কারণে আর কেউ সেটি শুনতে পারে না।
অথবা এটি হতে পারে যে, দুটি দরজা উন্মুক্ত থাকে নবীদের এই ধরনের অভিজ্ঞতায়। অবচেতন অথবা স্বপ্নরত মন হয়তো অতিপ্রাকৃত সেই জগতে প্রবেশ করে, সেই জগৎটি তার জন্যে আরো অভিগম্য হয়ে ওঠে। যদি আসলেই অন্য একটি বাস্তবতা থেকে থাকে অথবা আমাদের মনে সীমানার বাইরে আরেকটি মনের অস্তি ত্ব থাকে, আমাদের সাথে সেটির সংযোগ করার চেষ্টা করাটা খুব অসম্ভাব্য নয়। নবীদের সাথে এই ঐশী প্রকাশ বা উন্মোচনে যা ঘটে সেটি হচ্ছে, তারা সেই অন্য বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন এবং এর মন তাদের মনের সাথে কথা বলেছে। এবং তারা বাকি পৃথিবীর সবাইকে জানিয়েছিলেন যা তাদের বলা হয়েছে।
এই ‘এক দরজা’ তত্ত্ব আর ‘দুই দরজা’ তত্ত্বের মাঝখানে একটি মধ্যবর্তী অবস্থান আছে। হ্যাঁ, মানব-অবচেতনের হয়তো দুটি দরজা থাকতে পারে। আর মানবমনের হয়তো আসলেই এমন কিছুর সাথে সাক্ষাৎ হতে পারে। কিন্তু আমরা জানি অন্য একটি মন বোঝার ক্ষেত্রে ঠিক কতটা অনির্ভরযোগ্য হতে পারে মানুষ। সুতরাং স্বর্গীয় মনের সাথে সম্মিলন নিয়ে তাদের দাবিগুলোর ব্যাপারে আমাদের আসলে সতর্ক হতে হবে। আসলেই হয়তো অবচেতন মনের দুটি দরজা থাকতে পারে। কিন্তু যে-দরজাটি অন্য একটি জগতের দিকে উন্মুক্ত হয়, সেটির পুরোপুরি ভাবে খোলার সম্ভাবনা কম, সুতরাং নবীরা দেখেছেন বা শুনেছেন বলে দাবি করে থাকেন, সে-ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হতে পারি না।
মরুভূমিতে মোজেসের সাথে আসলে কী ঘটেছিল এবং ধর্মের প্রতি যে তিনটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি যা এটি প্রস্তাব করছে, সেগুলো আবা। বুঝতে আসুন আমরা আবার দরজার রূপকটা ব্যবহার করি। আপনি যদি ‘এক দরজা’ দৃষ্টিভঙ্গি নেন, মোজেসের একটি স্বপ্ন ছিল যা মিশরে তার স্বজাতির মানুষদের পরিত্রাতা হতে তাকে শক্তি দিয়েছিল এবং সংকল্পবদ্ধ করেছিল। যে গল্পটি আমরা আরো বিস্তারিত দেখব আগামী অধ্যায়ে। এই অভিজ্ঞতাটি ছিল আন্তরিক। এটি ঘটেছিল, কিন্তু পুরোপুরিভাবে এটি তার অবচেতন মন থেকে এসেছিল। ধর্মের প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গির ভালো একটি সমরূপ উদাহরণ এসেছে পুরনো সিনেমাহল থেকে, যা আমি শৈশবে খুব ভালোবাসতাম। সেই দিনগুলোয় চলচ্চিত্রগুলো প্রস্ফুটিত করা হতো সেলুলয়েডের ফিতার উপর। সিনেমাহলের পেছনে ব্যালকনির উপরে একটি বুথ বা কক্ষ থাকত, যেখান থেকে ছবিটি বিপরীতদিকের দেয়ালে রুপালি একটি পর্দায় প্রক্ষেপ করা হতো। আমরা যেখানে বসে থাকতাম দর্শক হিসাবে, সেখান থেকে আমরা শুধুমাত্র আমাদের সামনের দিকটা দেখতাম, কিন্তু এটি আসলে আসছে আমাদের পেছনের একটি যন্ত্র থেকে। ধর্ম নিয়ে ভাবার একটি উপায় হচ্ছে, এটি জীবনের রুপালি পর্দার উপর অবচেতন মনের ভয় আর কামনাগুলোর একটি প্রক্ষেপণ। মনে হতে পারে যে, ধর্মের উপস্থিতি আছে আমাদের বাইরে এবং এর একটি নিজস্ব জীবন আছে। কিন্তু আসলে এটি আসছে সম্পূর্ণভাবে আমাদের নিজেদের কল্পনার গভীর থেকে। এটি সম্পূর্ণভাবে মানুষেরই একটি উৎপাদন।