তারপর অন্যকিছু ঘটেছিল। তারা যে-গল্পগুলো বলেছিলেন সেটি তাদের অনুসারীরা মুখস্থ করেছিলেন। প্রথমে এটি মুখে-মুখে হস্তান্তরিত হয়েছে। কিন্তু একটি সময় সেগুলো কাগজের উপর লেখা হয়েছিল। তারপর এটি সেই বিশেষ বইয়ে রূপান্তরিত হয়েছিল, যেগুলোকে আমরা বলি, হলি স্ত্রিপচার বা পবিত্র গ্রন্থ। বা ধর্মগ্রন্থ, শাস্ত্র ইত্যাদি। দ্য বাইবেল! দ্য বুক! এবং এটাই ধর্মের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতাঁকে রূপান্তরিত হয়েছিল। আসলেই এটি একটি বই অবশ্যই, মানুষই এটি লিখেছে। আমরা এর ইতিহাস অনুসরণ করতে পারি। কিন্তু এর শব্দগুলোর মাধ্যমে অন্য জগতের বার্তা আমাদের জগতে নিয়ে আসা হয়েছে। এই বইটি সীমাবদ্ধ সময় আর অনন্তকালের মধ্যে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করেছে। মানুষকে এটি স্বর্গীয় সত্তার সাথে যুক্ত করেছে। আর সে-কারণে এটিকে বিস্ময়কর শ্রদ্ধার সাথে দেখা হয় আর গভীরভাবে অধ্যয়ন করা হয়। আর সে-কারণে যখন এটিকে ধ্বংস কিংবা অবজ্ঞা করা হয়, তখন বিশ্বাসীরা খুবই অপছন্দ করেন।
ধর্মের ইতিহাস হচ্ছে এইসব নবী আর সাধুদের গল্প এবং যে-আন্দোলনগুলো তারা শুরু করেছিলেন এবং যে-ধর্মগ্রন্থগুলো লেখা হয়েছে তাদেরকে নিয়ে। কিন্তু এটি বেশ বিতর্কিত আর মতানৈক্যেরও একটি বিষয়। এইসব নবীদের, এমনকি কারো কারো আদৌ অস্তিত্ব ছিল কিনা সেটি নিয়ে সন্দেহবাদীরা প্রশ্ন তুলেছেন। এইসব স্বর্গীয় বা ঈশ্বর বা তার প্রেরিত কোনো প্রতিনিধির দৃশ্য বা কণ্ঠস্বর নিয়ে করা নবীদের দাবিগুলো নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। অবশ্যই যুক্তিসংগত, কিন্তু মূল বিষয়টি বুঝতে ব্যর্থ হওয়ার একটি সম্ভাবনা আছে। যা সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে সেটি হচ্ছে, তাদের নিয়ে বলা সব গল্পে তাদের অস্তিত্ব আছে, যে-গল্পগুলো বহু। হাজার কোটি মানুষের জন্যে এখনো অর্থবহ।
এই বইটিতে আমরা সেই গল্পগুলো পড়ব, ধর্মগুলো আমাদেরকে যে গল্পগুলো এর নিজের সম্বন্ধে বলেছে, আসলেই এভাবে অতীতে ঘটনাগুলো ঘটেছিল কিনা সারাক্ষণ এমন কিছু জিজ্ঞাসা না করে। কিন্তু যেহেতু সেই প্রশ্নটিকে পুরোপুরি অবজ্ঞা করাও ভুল হবে, আমরা পরে অধ্যায়টি চিন্তা করে কাটাব, আসলেই কী ঘটে যখন ঐসব নবী আর সাধুরা কোনো ঐশী দৃশ্যের দ্রষ্টা হন বা কণ্ঠস্বর শোনেন। এইসব নবীদের মধ্যে একজনের নাম ছিল ‘মোজেস’।
০২. দরজাগুলো
ধরুন ১৩০০ বি.সি.ই. (খ্রিস্টপূর্বাব্দে) একদিন সকালে মিশরের সাইনাই মরুভূমিতে আপনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন। আপনি হয়তো দাড়িওয়ালা একজন ব্যক্তির দেখা পেতে পারেন, যিনি নগ্নপায়ে একটি কাঁটাঝোঁপের সামনে নতজানু হয়ে আছেন। আপনি দেখবেন তিনি গভীর মনোযোগের সাথে ঝোঁপের কথা শুনছেন, তারপর তিনি ঝোঁপটার সাথে কথা বলছেন, তারপর তিনি আবার শুনতে শুরু করেন। অবশেষে উদ্দেশ্যমূলক একটি সংকল্প নিয়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন, এবং সেখান থেকে দ্রুত হেঁটে চলে গেলেন। এই মানুষটির নাম হচ্ছে ‘মোজেস’। ধর্মের ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত নবীদের একজন ও ইহুদি ধর্মের একজন প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। একদিন তাকে নিয়ে যে গল্প লেখা হবে সেটি বলবে, এইদিনে জ্বলন্ত একটি ঝোঁপ থেকে ঈশ্বর তার সাথে কথা বলেছিলেন, এবং তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ক্রীতদাসদের একটি দলের নেতৃত্ব দিয়ে মিশর থেকে প্যালেস্টাইনে, তাদের প্রতিশ্রুত দেশে স্বাধীনতার পথে নিয়ে যেতে।
আপনার কাছে, যিনি বিষয়টি দেখছেন, কাঁটার সেই ঝোঁপটি কোনো আগুনে প্রজ্বলিত ছিল না, যা কিনা এটিকে পুড়িয়ে দাহ করতে পারে। উজ্জ্বল লাল রঙের ক্ষুদ্রাকার ফল দিয়ে এটি পূর্ণ ছিল। এবং যখন আপনি লক্ষ করবেন, মোজেস ঠিক কতটা মনোযোগী যখন কিনা সে ঝোঁপের কথা শুনছিল, যদিও আপনি শুনতে পারবেন না তাকে যা-কিছু তখন বলা হচ্ছিল, কিন্তু আপনি তার প্রতিউত্তরগুলো বুঝতে পারছিলেন। কিন্তু এইসব কিছু দেখে আপনি কিন্তু বিশেষভাবে বিস্মিত নন। আপনার ছোটবোনও তার পুতুলের সাথে এভাবে প্রাণবন্তভাবে কথা বলে। আর আপনার একজন অল্পবয়সি আত্মীয় আছেন, যিনি কাল্পনিক এক বন্ধুর সাথে কথা বলেন, যে বন্ধুটি তার কাছে তার বাবা-মার মতোই বাস্তব। আপনি হয়তো শুনেছেন যে, মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিরা অদৃশ্য শ্রোতাদের সাথে বেশ গভীরভাবেই কথোপকথন করতে পারেন। সুতরাং আপনি সেই ধারণাটির সাথে অভ্যস্ত, কিছু মানুষ আছেন যারা অন্যের কণ্ঠস্বর শুনতে পান, যা আর কেউই শুনতে পায় না।
কিন্তু আসুন, মোজেসের কাছ থেকে কিছুক্ষণের জন্য আমরা অন্যদিকে তাকাই এবং সেই অদৃশ্য বক্তার কথা ভাবি, যিনি তাকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন। আপনার মনের সেই ভাবনাটিকে স্থির করুন, সময় ও স্থানের বাইরে একটি অদৃশ্য বাস্তবতার ধারণা, যা সরাসরি মানুষের সাথে কথা বলতে পারে। সেই চিন্তাটিকে বোঝার চেষ্টা করুন, তাহলে আপনি ধর্মের কেন্দ্রীয় ধারণাটিকে উপলব্ধি করতে পারবেন। এই মহাবিশ্বে আমাদের শারীরিক সব ইন্দ্রিয়ের কাছে যা-কিছু লভ্য এবং বোধগম্য, তার বাইরে একটি শক্তি আছে এবং এটি নিজেকে উন্মোচিত করে অথবা জানান দেয় সেইসব বিশেষ মানুষগুলোর কাছে, যারা সেই বার্তাগুলো অন্যদের কাছে ঘোষণা ও প্রচার করে। আপতত আমরা এই বক্তব্যটির সাথে একমত কিংবা ভিন্নমত, কোনোটাই পোষণ করছি না। আমরা শুধু মূল ভাবনাটি খোঁজার চেষ্টা করছি। একটি অদৃশ্য শক্তির অস্তিত্ব আছে, যাকে আমরা ঈশ্বর বা গড বলছি এবং এটি আমাদের সাথে তার সম্পর্ক ধরে রেখেছেন!’ –এটাই হচ্ছে দাবি। আমরা যখন এই ইতিহাস অনুসন্ধানে আরো অগ্রসর হব, জানব যে ভিন্ন। ভিন্ন ধর্মগুলোর প্রত্যেকটিরই সেই দাবিটির ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ আছে, এবং আমাদেরকে সেগুলো সেটি বলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই কোনো প্রশ্ন ছাড়াই স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছেন, হ্যাঁ, এটি সেখানে আছে। আর তাদের বিশ্বাসের রূপটি এর অস্তিত্বের প্রতি সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ প্রতিউত্তর।