অবশ্যই, এর মানে এমন কিছু বলা হচ্ছে না যে, অন্য প্রাণীরা তাদের মৃত সঙ্গীদের জন্যে শোক প্রকাশ করে না। বহু প্রমাণ আছে যে, অনেক প্রাণী সেটি করে। এডিনবরায় ছোট একটি কুকুরের বিখ্যাত মূর্তি আছে, যার নাম ছিল ‘গ্রেফ্রায়ার্স ববি’, সেটি সাক্ষ্য দিচ্ছে কোনো প্রাণী কীভাবে দুঃখ অনুভব করে যখন তারা তাদের সাথে সম্পর্কযুক্ত এমন কাউকে হারায়। ববি মারা গিয়েছিল ১৮৭২ সালে, তার জীবনের শেষ চৌদ্দটি বছর সে তার মৃত মনিব, জন গ্রে’র কবরের উপর শুয়ে কাটিয়েছিল। কোনো সন্দেহ নেই ববি তার বন্ধুর অনুপস্থিতি গভীরভাবে অনুভব করেছিল, কিন্তু জন গ্রে’র মানব-পরিবারই তার জন্য প্রকৃত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল, এবং গ্রেফ্রায়ার্স কার্কইয়ার্ডে তাকে সমাহিত করেছিল। এবং তাকে সমাহিত করার মাধ্যমে তারা খুব বৈশিষ্ট্যসূচক মানব-আচরণগুলোর একটি আচরণ সম্পন্ন করেছিলেন। তাহলে কোন বিষয়টি মৃতদের সমাহিত করা শুরু করতে মানুষকে প্ররোচিত করেছিল?
মৃতদের ব্যাপারে যে সুস্পষ্ট ব্যাপারটি আমাদের নজরে পড়ে সেটি হচ্ছে তাদের ভিতরে যা-কিছু ঘটছিল সেটি ঘটা বন্ধ হয়ে গেছে। তারা আর শ্বাস নিচ্ছে না। আর নিশ্বাস নেবার কাজটির সাথে সেই ধারণাটিকে সংশ্লিষ্ট করা ছিল খুব ক্ষুদ্র একটি পদক্ষেপ : আমাদের ভিতরে কিছু বাস করছে, কিন্তু সেটি আমাদের ভৌত শরীর থেকে পৃথক এবং যা এটিকে জীবন দিচ্ছে। এর জন্য গ্রিক শব্দটি ছিল ‘সাইকি’, ল্যাটিন ‘স্পিরিটাস’, এই দুটোই এসেছে সেই ক্রিয়াপদগুলো থেকে, যার অর্থ শ্বাস নেওয়া অথবা ফুঁ দেওয়া। একটি ‘স্পিরিট’ অথবা ‘সোল’ বা ‘আত্মা’ হচ্ছে এমন কিছু, যা কোনো-একটি শরীরকে জীবন্ত করে ও এটিকে নিশ্বাস নেওয়ায়। খানিকটা সময়ের জন্যে একটি শরীরের মধ্যে এটি বাস করে। যখন শরীর মারা যায়, এটি শরীরটিকে ত্যাগ করে চলে যায়। কিন্তু এটি কোথায় যায়? একটি ব্যাখ্যা ছিল, এটি এই জগতের ওপারে অন্য সেই জগতে চলে যায়, ‘আত্মার জগৎ, আমরা পৃথিবীতে যে-জগতে বাস করছি, এটি সেই জগতেরই অপর পিঠ।’
প্রাচীন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া-সংশ্লিষ্ট আচরণগুলো যা আমরা আবিষ্কার করেছি সেগুলো সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করছে, যদিও আমাদের দূরের পূর্বসূরিরা, তারা কী চিন্তা করছিলেন তার নীরব কিছু চিহ্ন আমাদের জন্যে রেখে গেছেন। তখনও লেখার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি, সুতরাং তাদের চিন্তাগুলো কিংবা তাদের বিশ্বাসের বিবরণ তারা আমাদের জন্যে লিখে রেখে যেতে পারেননি, যেন আজ আমরা সেগুলো পড়তে পারি। কিন্তু তারা যা চিন্তা করেছিলেন সেই বিষয়ে আমাদের জন্যে কিছু ইঙ্গিত রেখে গেছেন। সেগুলো খুঁজে পেতে আমাদের বর্তমান ‘কমন’ সময়ের (যিশুর জন্ম) বেশ কয়েক হাজার বছর আগে ফিরে যেতে হবে। তবে আলোচনায় আরো অগ্রসর হবার আগে ‘বিসিই’, (‘বিফোর কমন এরা’ –কমন সময়ের আগে) শব্দটির একটি ব্যাখ্যা দরকার।
যখন অতীতে কোনো ঘটনা ঘটে, সেগুলো ঘটার দিন-তারিখ চিহ্নিত করার জন্যে কোনো বৈশ্বিক ক্যালেন্ডার বা উপায় থাকা গুরুত্বপূর্ণ। যা আমরা এখন ব্যবহার করি সেটি ষষ্ঠ শতাব্দীতে (কমন এরা) পরিকল্পনা করেছিল খ্রিস্টীয় জগৎ, যা প্রদর্শন করছে, আমাদের ইতিহাসে ধর্ম ঠিক কতটা প্রভাবশালী হতে পারে। হাজার বছর ধরে ক্যাথলিক চার্চ পৃথিবীর অন্যতম ক্ষমতাশালী একটি প্রতিষ্ঠান ছিল, এতই ক্ষমতাবান যে তারা সেই ক্যালেন্ডার নির্ধারণ করেছিল, যা আমরা এখনো ব্যবহার করছি। ক্যাথলিক চার্চের প্রতিষ্ঠাতা, যিশুখ্রিস্টের জন্ম ছিল এর কেন্দ্রীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তাঁর জন্মসাল হচ্ছে ‘ইয়ার ওয়ান’ বা প্রথম খ্রিস্টাব্দ। যা-কিছু এর আগে ঘটেছে সেগুলো ‘বিফোর ক্রাইস্ট’ বা বি.সি. বা খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এরপরে যে বছরগুলো এসেছিল সেটি হচ্ছে এ.ডি. বা আনো ডমিনি, দ্য ইয়ার অব দ্য লর্ড (আমাদের প্রভুর বছর)।
আমাদের এই সময়ে বি.সি. আর এ.ডি, প্রতিস্থাপিত হয়েছে বি.সি.ই. বা বিফোর কমন এরা অথবা সি.ই. বা উইদইন কমন এরা শব্দগুলো দিয়ে, যে শব্দগুলো কোনো ধর্মীয় ইঙ্গিত ছাড়াই অনুবাদ করা যেতে পারে : হয় খ্রিস্টীয় যুগের পূর্বে বা বি.সি.ই. এবং খ্রিস্টীয় যুগের মধ্যে বা সি.ই. অথবা কমন এরার পূর্বে বা বি.সি.ই. অথবা কমন এরার মধ্যে বা সি.ই.। কীভাবে এই শব্দগুলো বুঝবেন সেটি আপনি নিজেই বাছাই করতে পারেন। এই বইয়ে আমি বি.সি.ই. ব্যবহার করব সেই ঘটনাগুলোকে চিহ্নিত করতে, যেগুলো ঘটেছিল খ্রিস্টের জন্মের আগে অথবা কমন এরার আগে। কিন্তু লেখার মধ্যে বিশৃঙ্খলা যেন সৃষ্টি না হয়, সেজন্য আমি সি.ই. শব্দটির পরিমিত ব্যবহার করব এবং শুধুমাত্র যেখানে প্রয়োজনীয় সেখানেই সেটি শুধু ব্যবহার করব। সুতরাং যদি এমন কোনো তারিখ আপনার চোখে পড়ে যার পরে বি.সি.ই কিংবা সি.ই, শব্দটি নেই, আপনি জানবেন যে এটি উইথইন দ্য ক্রিশ্চিয়ান অথবা কমন এরা হবে (অর্থাৎ খ্রিস্টাব্দ)।
যাই হোক, ১৩০,০০০ বি.সি.ই. (খ্রিস্টপূর্ব) থেকেই আমাদের পূর্বসূরিরা যেভাবে তাদের মৃতদের সমাহিত করতেন সেখান থেকে তাদের একধরনের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রমাণ আমরা পাই। কবরের মধ্যে মৃতদেহের পাশে খাদ্য, ব্যবহার করার মতো হাতিয়ার বা যন্ত্র আর অলংকার সাজিয়ে রাখা হয়েছে, এমন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে, যা মৃতরা একধরনের মৃত্যুপরবর্তী জীবনের পথে যাত্রা করে এবং সেই যাত্রার জন্যে তাদের প্রস্তুত করে প্রেরণ করা প্রয়োজন, এমন একধরনের বিশ্বাসের উপস্থিতি প্রস্তাব করে। আরেকটি আচরণ ছিল, মৃতদের শরীর লাল গিরিমাটি দিয়ে চিত্রিত করা; হয়তো চলমান জীবনের প্রতীকী প্রকাশ ছিল সেটি। এটি আবিষ্কৃত হয়েছিল আপাতত খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীনতম সমাধিক্ষেত্রে, একটি মা ও শিশুর সমাধি ছিল এটি, ইজরায়েলের কাফজে হতে, এটির সময়কাল প্রায় ১০০,০০০ বি.সি.ই. (খ্রিস্টপূর্ব)। ঠিক সেই একই আচরণ আবার খুঁজে পাওয়া যায় অর্ধেক পৃথিবী দূরত্বে অস্ট্রেলিয়ার লেক মুংগো এলাকা, ৪২,০০০ বি.সি.ই. সময়কালের, যেখানে সমাহিত ব্যক্তির শরীর চিত্রিত ছিল লাল গিরিমাটি দিয়ে। মৃতদেহের শরীর-চিত্রায়ন মানবতার সবচেয়ে বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ ধারণাগুলোর উন্মেষকাল হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, সেটি হচ্ছে প্রতীকী চিন্তা। ধর্মে এমন চিন্তা খুব ব্যাপকভাবেই উপস্থিত, সুতরাং বিষয়টি বোঝা খুব জরুরি।