ধর্ম পৃথিবীর সব সহিংসতার কারণ, এমন কিছু ভাবা পশ্চিমে খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়। যদিও কিছু বিশেষজ্ঞ জোরালো যুক্তি দিয়েছেন এই দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে, যেমন, তাদের মধ্যে সুপরিচিত ধর্মীয় ইতিহাসবিদ কারেন আর্মস্ট্রং, হলোওয়ের মতো একসময় তিনিও ধর্মের সাথে যুক্ত ছিলেন (ক্যাথলিক নান), যিনি এখন সেটি ত্যাগ করার পর পুরো বিষয়টিকে একটি নির্মোহ দৃষ্টি দিয়ে দেখে থাকেন। তিনি মনে করেন, ঈশ্বরের নামের দাবি করে সহিংসতা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বাস্তবে সেই সংঘর্ষের কারণগুলো ছিল অন্য রাজনৈতিক, সামাজিক, বর্ণবাদী এবং অর্থনৈতিক। হলোওয়ে এই দৃষ্টিভঙ্গিটি আংশিক মেনে নিয়েছেন, কিন্তু তিনি ধর্মকে এই অপরাধ থেকে দায়মুক্ত করতে অনিচ্ছুক, তিনি তাগাদা দেন এখনও। ইতিহাসের সবচয়ে খারাপতম সহিংসার কারণ হয়েছে এটি, সুতরাং যদি আমরা ঈশ্বর বলতে বোঝাই এই মহাবিশ্বের একজন প্রেমময় দয়াশীল ঈশ্বর, তাহলে তার হয় কোনো অস্তিত্ব নেই অথবা তাকে পুরোপুরিভাবে ভুল বুঝেছে ধর্ম।
অবশ্যই ১৩০,০০০ বছরের ইতিহাসকে সংক্ষেপ করার প্রচেষ্টাটির কিছু সীমাবদ্ধতা আছে; যেমন, খ্রিস্টধর্মের মেথোডিস্ট আর ব্যাপ্টিস্টরা হয়তো মনোক্ষুণ্ণ হয়েছেন, যখন তাদের উপেক্ষা করা হয়েছে এবং অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ধর্মগোষ্ঠী কোয়েকাররা এই বইয়ে পুরো একটি অধ্যায় পেয়েছেন। একই সাথে বিশ্বাসের জটিল কাঠামোটিকে মূলসারে পরিস্রবণ করতে গিয়ে, যা বহু হাজার বছর ধরে বিবর্তিত হয়েছে, আর সেগুলো সংক্ষিপ্ত আর স্বচ্ছ বাক্যে ব্যক্ত করতে খানিকটা সমঝোতার আশ্রয় তাকে নিতে হয়। আমাদের সময়ে এই বইটির যদি কোনো বার্তা থেকে থাকে, তবে সেটি এসেছিল যখন হলোওয়ে উল্লেখ করেছিলেন, ধর্মের টিকে থাকার অসাধারণ একটি প্রবৃত্তি আছে; তিনি লিখেছেন : এটি সেই কামারের নেহাই যা বহু হাতুড়ি ক্ষয় করেছে। সুতরাং এই ধারণার ভিত্তিতে বলা যায়, আমাদের পূর্বপরিজ্ঞেয় ভবিষ্যতে এটি তার অস্তিত্ব ধরে রাখবে; আর তাদের সম্বন্ধে আরো কিছু জানতে এই আলোকিত বইটির পাতার মতো আর কোনো উত্তম জায়গা নেই।
কাজী মাহবুব হাসান
সেপ্টেম্বর, ২০১৯
১. উপরে কি কেউ আছেন?
ধর্ম কী? আর কোথা থেকে এটি এসেছে? ধর্ম এসেছে মানব প্রাণীদের মন থেকে, সুতরাং আমাদের কাছ থেকেই এটি এসেছে। আপাতদৃষ্টিতে প্রতীয়মান যে, পৃথিবীর অন্য কোনো প্রাণীরই ধর্মের প্রয়োজন নেই। আর আমরা যতদূর বলতে পারি তারা কোনো ধর্মও সৃষ্টি করেনি। তার কারণ, আমাদের চেয়ে তারা তাদের জীবনের সাথে অনেক বেশি একাত্ম। সহজাত প্রবৃত্তি অনুযায়ী তারা আচরণ করে। তারা তাদের অস্তিত্বের স্বাভাবিক ধারাবাহিকতার সাথেই জীবন কাটায় সারাক্ষণ সেই বিষয়ে না-ভেবে। মানব প্রাণী সেই কাজটি করার ক্ষমতা হারিয়েছে। আমাদের মস্তিষ্ক এমনভাবে গড়ে উঠেছে যে, এটি আমাদের আত্মসচেতন করে তোলে। নিজেদের ব্যাপারে আমরা বেশ কৌতূহলী। কোনোকিছু নিয়ে না-ভেবে আমরা থাকতে পারি না। আমরা চিন্তা না করে থাকতে পারি না।
আর সবচেয়ে বড় যে-বিষয়টি নিয়ে আমরা চিন্তা করি, সেটি এই মহাবিশ্ব নিয়ে, এবং কোথা থেকে এটি এসেছে সেই বিষয়ে। কেউ কি কোথাও আছেন যিনি এটি সৃষ্টি করেছেন? আর সম্ভাব্য সেই কেউ বা কোনোকিছুকে বোঝাতে আমরা যে-শব্দটি ব্যবহার করি সেটি হচ্ছে ‘গড’ বা ‘ঈশ্বর’, গ্রিক ভাষায় ‘থিওস’, আর এমন কেউ যিনি মনে করেন একজনের ঈশ্বর আছেন তাকে বলা হয়। ‘থেইস্ট বা আস্তিক’। আর যিনি ভাবেন কোথাও এমন কেউ বা কিছু নেই আর এই মহাবিশ্বে আমরা একা, তাদের বলা হয় ‘এথেইস্ট বা নাস্তিক’। আর ঈশ্বরকে নিয়ে অধ্যয়ন আর আমাদের কাছে তিনি কী চাইছেন সেই বিষয়ে জ্ঞানার্জনকে বলা হয় ধর্মতত্ত্ব বা ‘থিওলজি’। আরেকটি বড় প্রশ্ন যা আমরা নিজেদেরকে না করে থাকতে পারি না, সেটি হচ্ছে, মৃত্যুর পরে আমাদের সাথে কী ঘটবে? যখন আমরা মারা যাব, সেটাই কি শেষ নাকি এর পরে আরো কিছু ঘটবে? আর যদি কিছু থেকে থাকে, কেমন হবে সেটি?
যা আমরা ধর্ম বলে চিহ্নিত করি, সেটি হচ্ছে এইসব প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্যে আমাদের প্রথম প্রচেষ্টা। প্রথম প্রশ্নটির জন্যে এর উত্তর খুব সহজ। মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছে একটি শক্তিশালী সত্তা, যাকে আমরা কেউ কেউ ‘গড’ বা ‘ঈশ্বর’ বলি, এবং যা-কিছু তিনি সৃষ্টি করেছিলেন, সেগুলো নিয়ে তার কৌতূহল আর সেখানে হস্তক্ষেপ করা অব্যাহত রেখেছেন। ঈশ্বর নামের শক্তিশালী সত্তাটি কেমন, এবং আমাদের কাছে এটি কী প্রত্যাশা করে, প্রতিটি ধর্ম সেই বিষয়ে পৃথক পৃথক সংস্করণ প্রস্তাবনা করেছে, কিন্তু সেগুলোর প্রত্যেকটি কোনো-না-কোনো একটি রূপে এর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। সেগুলো আমাদের বলে, এই মহাবিশ্বে আমরা একা নই। আমাদের বোধের সীমানার বাইরেও অন্য বহু বাস্তবতা আছে, অন্য জগৎ। আমরা তাদের ‘অতিপ্রাকৃত’ বলি, কারণ সেগুলো এই প্রাকৃতিক জগতের বাইরে অবস্থিত, যে প্রাকৃতিক জগৎটি আমাদের ইন্দ্রিয়ের কাছে তাৎক্ষণিকভাবে অভিগম্য।
যদি ধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বাসটি হয়, এই জগতের বাইরে আরো একটি বাস্তবতার অস্তিত্বের ওপর বিশ্বাস, যাকে আমরা ঈশ্বর বলছি, তাহলে কী এই বিশ্বাসটিকে প্ররোচিত বা অনুপ্রাণিত করেছিল, আর কখন এটি শুরু হয়েছিল? এটি শুরু হয়েছিল বহু যুগ আগে। বাস্তবিকভাবে, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, এমন কোনো সময় আসলেই কখনো ছিল না, যখন মানুষ এই পৃথিবীর বাইরে একটি অতিপ্রাকৃত জগতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেনি। এবং মানুষ মারা যাবার পর সেই মানুষগুলোর সাথে কী ঘটে সেই বিষয়টি নিয়ে কল্পনা আর ভাবনা হয়তো এইসব কিছুর সূচনা করেছিল। সব প্রাণীই মারা যায়, কিন্তু অন্যদের ব্যতিক্রম, মানুষ তাদের স্বজনদের মৃতদেহ যেখানে তারা মারা যাচ্ছে সেখানে পড়ে পচার জন্যে ফেলে রেখে যায় না। যতদূর আমরা সেই মানুষগুলোর ইতিহাস অনুসরণ করতে পারি, মানুষ স্পষ্টতই মৃতদের জন্যে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন করত। আর তারা সেই অনুষ্ঠানটি যেভাবে পরিকল্পনা করতেন, সেটি তাদের সবচেয়ে প্রাচীনতম বিশ্বাসগুলো সম্বন্ধে আমাদের কিছুটা ধারণা দেয়।