এরপর তিনি সেই সাধুদের খুঁজতে গিয়েছিলেন যাদের তিনি হতাশ করেছিলেন তাদের বোধিলাভের পথ অনুসরণ না করে। উত্তর-ভারতে গঙ্গার তীরে অবস্থিত একটি শহর বারানসীর একটি মৃগ-উদ্যানে তিনি তাদের খুঁজে পান। একসময় তাদের পরিত্যাগ করা সত্ত্বেও তারা তাকে সৌজন্যের সাথে স্বাগত জানিয়েছিলেন। বারানসীর নিকট ঋষিপতনের এই মৃগ-উদ্যানে যাত্রা করে তার সাধনার সময়ের পাঁচ প্রাক্তন সঙ্গীদের তিনি তার প্রথম শিক্ষা প্রদান করেন। এইভাবে তাদের নিয়ে ইতিহাসের প্রথম বৌদ্ধসংঘটি গঠিত হয়েছিল। তাদের নম্র অভিযোগ যে, কৃচ্ছসাধনের জীবন ত্যাগ করে তিনি বোধিলাভ করার সুযোগ হারিয়েছেন, এর উত্তরই ছিল বুদ্ধের প্রথম ধর্মশিক্ষা, যা বৌদ্ধ ঐতিহ্যে ‘ধর্মচক্রবর্তন’ নামে খ্যাত। (সার্সন অব দ্য টার্নিং অব দ্য হুইল)। এই শিক্ষা দেবার সময় তিনি আবার সেই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করেছিলেন যা বোধিলাভের উদ্দেশ্যে তার গৃহত্যাগ করার মুহূর্ত থেকেই তার মনে সবসময়ই উপস্থিত ছিল। সামসারা’র এই ঘূর্ণায়মান চক্রকে থামাতে পারে কি, যার সাথে আমাদের তৃষ্ণাগুলো আমাদের শৃঙ্খলিত করে রেখেছে? প্রশ্নটির যে উত্তর তিনি দিয়েছিলেন সেটি হচ্ছে : এর থেকে বের হবার উপায় হচ্ছে দুই চূড়ান্ত উপায়ের মধ্যবর্তী পথটি। তিনি এটিকে বলেছিলেন মধ্যম পন্থা (দ্য মিডল পাথ)। তিনি সন্ন্যাসীদের বলেন : দুটি চূড়ান্ত পথ আমাদের এড়িয়ে চলতে হবে। একটি সুখানুভূতি অর্জনের জীবন, এবং এর কামনা, এটি অধঃপাত, এবং এখানে কোনো লক্ষ্য বা মুক্তি নেই। আরেকটি চূড়ান্ত প্রান্ত হচ্ছে আত্ম অস্বীকৃতির জীবন। এটি কষ্টকর, এখানেও কোনো মুক্তি নেই। এই দুটি চূড়ান্ত পথ এড়িয়ে যদি আমরা মধ্যম পন্থা অর্জন করি, এটি আমাদের বোধিলাভের দিকে নিয়ে যায়। এই মধ্যম পথের নির্দেশকগুলো হচ্ছে চারটি মহান সত্য, চতুরার্য সত্য (ফোর নোবেল ট্রুথ, চতুরার্য প্রধান জ্ঞান দর্শন। এই চারটি সত্য হল : দুঃখ, দুঃখ-সমুদয়, দুঃখ-নিরোধ ও দুঃখ-নিরোধ মার্গ। চতুরার্য সত্যের প্রথম সত্য হল দুঃখ। দ্বিতীয় সত্য হল দুঃখ সমুদয় বা দুঃখের কারণ হচ্ছে তৃষ্ণা বা আসক্তি। তৃষ্ণাকে দৃঢ়ভাবে সংযত করে ও ক্রমশ পরিত্যাগ করে বিনাশ করাকে গৌতম বুদ্ধ দুঃখ-নিরোধ বলেছেন। চতুরার্য সত্যের প্রথম তিনটি সত্য দুঃখের বৈশিষ্ট্য ও কারণকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, এর চতুর্থ সত্য দুঃখ-নিবারণের ব্যবহারিক উপায় দর্শায়। গৌতম বুদ্ধ দ্বারা বর্ণিত দুঃখ-নিরোধ মার্গ বা দুঃখ-নিরসনের উপায়কে অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলা হয়। পুরো জীবনটাই পূর্ণ দুঃখে। আর দুঃখের কারণ হচ্ছে কামনা/তৃষ্ণা/আসক্তি। আর তৃষ্ণাকে নিরোধ বা বর্জন করা যেতে পারে। আর দুঃখ নিরসনের উপায় হচ্ছে তার অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ করা (এইটফোন্ড পাথ বা অষ্টাঙ্গিক মার্গ : গৌতম বুদ্ধ দ্বারা বর্ণিত দুঃখ-নিরোধ মার্গ বা দুঃখ-নিরসনের উপায়। এটি বৌদ্ধধর্মের মূলকথা চতুরার্য সত্যের চতুর্থতম অংশ।)
বুদ্ধ প্রয়োগবুদ্ধিসম্পন্ন একজন ব্যক্তি ছিলেন, তিনি কর্মে বিশ্বাস করতেন। আর এই ধরনের মানুষদের বিশেষভাবে লক্ষণীয় একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা তালিকা তৈরি করতে পছন্দ করেন; যেমন, কী করতে হবে, কী মনে রাখতে হবে, বাজারে গেলে কী কী কিনতে হবে ইত্যাদি। আর বুদ্ধের অষ্টাঙ্গিক মার্গের তালিকাটি হচ্ছে দুঃখের, কারণ তৃষ্ণাকে দূর করার জন্যে যা-কিছু করতে হবে : সম্যক দৃষ্টি/বিশ্বাস, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক প্রযত্ন, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি। সম্যক বা সঠিক বিশ্বাস আর সঠিক সংকল্প হচ্ছে মধ্যম পথ খোঁজা এবং সেটি অনুসরণ করা। এরপরে হচ্ছে সেই সিদ্ধান্ত : কখনোই পরনিন্দা অথবা কটুবাক্য ব্যবহার না করা। এমনকি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কোনোকিছু চুরি, হত্যা অথবা লজ্জাজনক কোনো কাজ করতে অস্বীকার করা, এবং সেইসব পেশা বর্জন করা, যা অন্যের ক্ষতি করে।
বৌদ্ধধর্ম হচ্ছে একটি অনুশীলন; এটি কোনো ধর্মীয় মতবিশ্বাস বা মতবাদ নয়। এখানে কোনোকিছু বিশ্বাস করার বিষয় নেই বরং কিছু করার বিষয় আছে। এর কার্যকারিতার মূল চাবিটি হচ্ছে ধ্যানের মাধ্যমে অস্থির সেই তৃষ্ণার্ত মনকে নিয়ন্ত্রণ করা। স্থির হয়ে বসে, এবং কীভাবে তারা শ্বাস নিচ্ছেন সেটি লক্ষ করে, কোনো একটি শব্দ আর একটি ফল নিয়ে ধ্যান করার মাধ্যমে এর অনুশীলনকারীরা সচেতনতার বিভিন্ন স্তরে অতিক্রম করে শান্ত ও সুস্থির হবেন, যা তাদের তৃষ্ণাকে হাস করে। বুদ্ধ হয়তো একমত হতেন সপ্তদশ শতাব্দীর ফরাসি চিন্তাশীল দার্শনিক ব্লেইজ পাসকলের সেই অন্তদৃষ্টির সাথে : ‘একটি ঘরে সুস্থির বসে থাকতে পারার অক্ষমতাই সব মানবিক অশুভ কর্মকাণ্ডের কারণ।’
বুদ্ধের মধ্যম পন্থার ব্যাখ্যায় প্রণোদিত হয়ে সেই সন্ন্যাসীরা তার অনুসারীতে পরিণত হয়েছিলেন; এবং সংঘ, বৌদ্ধ সন্ন্যাসী আর সন্ন্যাসিনীদের সংগঠনটির জন্ম হয়েছিল। যদিও বুদ্ধের শিক্ষা কোনো ধর্মীয় মতবিশ্বাস এর অনুসারীদের ওপর চাপিয়ে দেয়নি, তবে এর ভিত্তিতে আছে ভারতীয় ধর্মের দুটি প্রধান ধারণা : কার্মা এবং সামসারা; কর্মের সেই আইন যা বহু লক্ষবার পুনর্জন্মের কারণ, তিনি শিখিয়েছিলেন যে, পুনর্জন্মের এই চক্রটি বন্ধ করার সবচেয়ে দ্রুততম উপায় হচ্ছে সন্ন্যাস নেওয়া এবং শৃঙ্খলার অনুশাসন মেনে চলা যা এর অনুশীলনকারীকে বোধিলাভ করার পথে নিয়ে যাবে। কিন্তু যদি পরিস্থিতি এমন কিছু করা আপনার জন্যে অসম্ভব করে তোলে, সেক্ষেত্রে সবচেয়ে সেরা উপায়টি হচ্ছে একটি নৈতিক জীবন কাটানো, এমন আশায় যে, পরের বার যেন আপনি সেই অবস্থা অর্জন করতে পারেন, যেখানে সন্ন্যাসী বা সন্ন্যাসিনীর কমলা আলখাল্লা পরা আপনার জন্যে সম্ভব হতে পারে।
বেনারসে প্রথম ধর্মপ্রচারের পর পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে বুদ্ধ ভ্রমণ করেছিলেন, এবং তার সন্ন্যাসী আর সন্ন্যাসিনীদের সংঘটিকে আরো মজবুত করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। যখন তিনি মৃত্যুর কাছাকাছি উপস্থিত হয়েছিলেন, তিনি তার অনুসারীদের বলেছিলেন, তার এই মহাপরিনির্বাণ গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ তার শিক্ষা। রয়ে যাবে। এবং এই শিক্ষাগুলোই গুরুত্বপূর্ণ। রাজকুমার, যিনি বুদ্ধ হয়েছিলেন বেনারসের উত্তর-পূর্বে একটি শহরে, তার শেষ যাত্রাটি করেছিলেন মহাপরিনির্বাণের আগে (কুশীনগর)। অসুস্থতা অনুভব করে সেখানে তিনি দুটি শালবৃক্ষের মাঝে একটুকরো কাপড় বিছিয়ে তার উপর শুয়ে পড়েছিলেন, এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়েছিল। তখন তার বয়স হয়েছিল আশি। যে ধর্মটি সিদ্ধার্থ গৌতম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেটি সারা এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল, এবং সময়ের একটি পর্যায়ে এটি বিশ্বধর্মে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু তার জন্মদেশে আজ এর অনুসারীর সংখ্যা বেশ কম, জৈনধর্মের ব্যতিক্রম, যাকে আর কোথাও পাওয়াই যায় না বললেই চলে। পরের অধ্যায়ে আমরা সেটি নিয়ে আলোচনা করব।
০৬. কোনো ক্ষতি কোরো না
বৌদ্ধধর্মের মতো, জৈনধর্মও সেই প্রশ্নটির একটি উত্তর, হিন্দুধর্ম মানবতাকে যে প্রশ্নটির মুখোমুখি করেছিল। যদি আমাদের বর্তমান অস্তিত্বটি শুধুমাত্র ভবিষ্যতে কাটাতে হবে এমন বহুজীবনের সবচেয়ে সাম্প্রতিকতমটি হয়ে থাকে, কারণ আমাদের কার্মা পুনর্জন্মের সেই চক্রে আমাদের বন্দি করে রেখেছে, তাহলে কীভাবে আমরা এখান থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারি এবং পালিয়ে যেতে পারি সেই অবস্থায়, যাকে বলা হয় ‘নির্বাণ’? নির্বাণ হচ্ছে সংস্কৃত একটি শব্দ, যার অর্থ মোমবাতির শিখার মতো নিভে যাওয়া। এটি অর্জিত হয় যখন আত্মা অবশেষে ‘সামসারা’ থেকে মুক্তি পায়। বুদ্ধের উত্তর ছিল দুই চূড়ান্তের মধ্যম পন্থা। জৈনধর্ম এর বিপরীত দিকে গিয়েছিল। এটি কল্পনাযোগ্য সবচেয়ে কঠোর আত্ম-অস্বীকৃতির পথ নির্বাচন করেছিল। আর এর অনুসারীদের জন্য চূড়ান্ত আদর্শ ছিল সাল্লেখানা বা সন্ত্রা আচারটি পালন করা এবং উপোস করার মাধ্যমে নিজেদের মৃত্যু নিশ্চিত করা।
‘জৈন’ শব্দটি যে সংস্কৃত ক্রিয়াপদ (জিন) থেকে এসেছে, তার অর্থ হচ্ছে ‘জয় করা। এটি সেই যুদ্ধটির তথ্যনির্দেশ করছে, যে যুদ্ধটি জৈনধর্মানুসারীদের তাদের নিজেদের প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়তে হয়, বোধিলাভের সেই পর্যায় পৌঁছাতে, যা তাদের মুক্ত করে (জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি)। জৈনধর্মের চব্বিশ জন ‘জিন’ অথবা বিজয়ী ছিলেন, যারা তাদের সব তৃষ্ণার ওপর এমন দক্ষতা অর্জন করেছিলেন যে, তারা বোধিলাভ করেছিলেন। তারা তীর্থঙ্কর’ নামে পরিচিত ছিলেন [(জৈনধর্মে একজন তীর্থঙ্কর হলেন এক সর্বজ্ঞ শিক্ষক ঈশ্বর, যিনি ধর্ম (নৈতিক পথ) শিক্ষা দেন।] ‘তীর্থঙ্কর’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘তীর্থের প্রতিষ্ঠাতা’। আর জৈনধর্মে ‘তীর্থ’ বলতে ‘সংসার’ নামক অনন্ত জন্ম ও মৃত্যু সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে প্রসারিত একটি সংকীর্ণ পথকে বোঝায়, তীর্থঙ্করদের ‘শিক্ষক ঈশ্বর’, ‘পথ স্রষ্টা, যাত্রাপথ-স্রষ্টা’ ও ‘নদী পারাপারের পথস্রষ্টা; কারণ পুনর্জন্মের সেই নদীর উপর দিয়ে অন্যপ্রান্তে মোক্ষ (মুক্তি)-লাভের দিকে তারা আত্মাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যান। এইসব তীর্থঙ্করদের মধ্যে যিনি সর্বশেষ, তাকে সাধারণত জৈনধর্মের (জিন সাশন) প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বর্ণনা করা হয়। তার নাম ছিল বর্ধমান, যদিও তিনি মহাবীর (মহান বীর) নামেই পরিচিত হয়েছিলেন। জৈনধর্মীয় ঐতিহ্য আমাদের জানাচ্ছে তিনি ৫৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, পূর্বভারতের। গাঙ্গেয় অববাহিকায়; এই এলাকায় সিদ্ধার্থ গৌতমও জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যিনি বুদ্ধ নামে পরিচিত হয়েছিলেন।