এই সিদ্ধান্তটি নেবার পর তিনি তার বিছানা থেকে উঠে পড়েছিলেন, তার স্ত্রী আর পুত্রকে নীরবে বিদায় জানিয়ে তিনি ছন্নকে ডেকে পাঠান। সারথি ছন্নকে নিয়ে তার প্রিয় ঘোড়া কন্থকের টানা রথে তারা রাতের অন্ধকারে প্রাসাদের বাইরে বের হয়ে আসেন। প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যখন তারা বনের প্রান্তে এসে পৌঁছান, সিদ্ধার্থ রথ থেকে নেমে তলোয়ার দিয়ে তার দীর্ঘ চুল কেটে মুণ্ডিতমস্তক হন। তিনি ছন্নকে তার চুলের গোছাটি দেন এবং তাকে প্রাসাদে ফেরত পাঠান, যেন সেটি সে প্রমাণ হিসাবে দেখাতে পারে, আজ থেকে তিনি একটি নতুন জীবনের পথে যাত্রা শুরু করেছেন। এরপর তিনি তার মূল্যবান রাজবস্ত্র একটি ভিখারির ছিন্নবস্ত্রের সাথে রদবদল করে নেন, এবং গৃহহীন এক তীর্থযাত্রী হিসাবে তার যাত্রা শুরু করেন। রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৌতম যখন ভিক্ষুকের জীবন বেছে নিয়েছিলেন তখন তার বয়স ছিল উনত্রিশ। তার কাহিনির এই মুহূর্তটি পরিচিত মহাভিনিষ্ক্রমণ (দ্য গ্রেট রিনানসিয়েশন) নামে।
ছয় বছর তিনি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছিলেন, বোধিলাভ আর বাসনা থেকে মুক্তি পাবার শ্রেষ্ঠ উপায় অনুসন্ধান করে। তার সাথে দেখা হওয়া সাধুরা দুটি পথ প্রস্তাব করেছিলেন। একটি ছিল খুব কঠোর মানসিক অনুশীলন, যা পরিকল্পিত হয়েছে মনকে শৃঙ্খলাপূর্ণ এবং বাসনাগুলোকে স্থির করতে। সিদ্ধার্থ এই কৌশলটি আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন এবং এগুলো সহায়ক এমন প্রমাণও পেয়েছিলেন। কিন্তু এটি তার সেই চূড়ান্ত মুক্তি বা বোধিলাভ যা তিনি অনুসন্ধান করছিলেন তা নিকটে আনতে পারেননি। সুতরাং তিনি ধ্যানে মগ্ন হয়ে থাকা সাধুদের ত্যাগ করে আবার তার যাত্রা শুরু করেন। এভাবে তিনি একদল সন্ন্যাসীর দেখা পান, যারা অনশন, শারীরিক নিপীড়ন ও কঠোর সাধনার তপস্যা করতেন। তারা তাকে বলেছিলেন, যত তীব্রতার সাথে তিনি তার শরীরকে ত্যাগস্বীকার করাতে পারবেন, ততই সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে তার মন। আপনি যদি আত্মার মুক্তি চান, তাহলে আপনাকে অবশ্যই অনশন করতে হবে, শরীরকে অভুক্ত রাখতে হবে। সিদ্ধার্থ আত্ম-অস্বীকৃতির এই আচার শুরু করেছিলেন, যা তাকে প্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি নিয়ে এসেছিল। এই সময়ে তার নিজের সম্বন্ধে বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন :
যখন আমি দিনে মাত্র একটি ফল খেয়ে বেঁচে ছিলাম আমার শরীর শীর্ণ আর রুগ্ণ হয়েছিল… আমার হাতপাগুলো পরিণত হয়েছিল যেন শুকনো কোনো লতাগাছের জটগুলো.. ভেঙে পড়া ছাদের কড়ি-বরগার রূপ নিয়ে ছিল আমার বুকের রুগ্ণ পাজর.. যদি আমি আমার পেটটা ছুঁতে যেতাম, হাতে ধরা পড়ত আমার মেরুদণ্ড।
তিনি আপন মনেই চিন্তা করেছিলেন : এই শারীরিক কৃচ্ছসাধনের তত্ত্ব যদি সত্য হয়, নিশ্চয়ই আমি ইতিমধ্যেই বোধিলাভ করে ফেলতাম, কারণ আমি প্রায় মৃত্যুর সীমানায় এসে উপস্থিত হয়েছি। এখন এতই দুর্বল যে, তিনি তার শরীর নিয়ে দাঁড়াতেও পারছিলেন না। এমনকি আর একবিন্দু তার শরীরটাকে টেনে নিয়ে যেতে পারছিলেন না। সিদ্ধার্থ জ্ঞান হারিয়েছিলেন। তার সতীর্থরা ভেবেছিলেন, তিনি হয়তো আসন্ন মৃত্যুর মুখোমুখি, কিন্তু তিনি আরোগ্য লাভ করেছিলেন। এবং যখন তিনি তার স্বরূপে ফিরে এসেছিলেন, তখন সন্ন্যাসীদের বলেছিলেন, তিনি একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। ছয় বছরের তীব্র ধ্যান আর আত্ম-অস্বীকৃতি তার খুঁজে-বেড়ানো বোধির আদৌ কাছাকাছি তাকে নিয়ে আসতে পারেননি। সুতরাং তিনি এই অনশন আর আত্মনিপীড়ন বন্ধ করবেন। তার এই ঘোষণায় ব্যথিত হয়ে সন্ন্যাসীরা তাকে ত্যাগ করে চলে যান, এবং সিদ্ধার্থ একাই তার পথ চলতে শুরু করেন।
তিনি একটি বন্য অশ্বথগাছের কাছে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন, এর ছায়ায় বিশ্রাম নেবার সময় তিনি একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যদি আমার চামড়া, স্নায় আর অস্থি ক্ষয় হয়েও যায়, আমার জীবন-রক্ত শুকিয়েও যায়, তারপরও যতক্ষণ-না আমি সত্যজ্ঞান লাভ করছি আমি এখানেই বসে থাকব। সাত দিন পর, তিনি হঠাৎ করেই অনুধাবন করেছিলেন, তার নিজের মধ্য থেকে তৃষ্ণা দূর করার তৃষ্ণাটিও একটি তৃষ্ণা। তিনি অনুধাবন করেছিলেন এই বাসনা থেকে মুক্তি পাবার বাসনাই তার নিজের বোধিলাভ করার পথের অন্তরায়। এবং যখন এই অন্তদৃষ্টির প্রকৃত অর্থ তার কাছে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, তার মনের মধ্যে বিকশিত হয়েছিল, তিনি সচেতন হয়ে উঠেছিলেন যে, তিনি এখন সব বাসনাশূন্য, সব তৃষ্ণা থেকে মুক্ত। তিনি পরমানন্দময় একটি অবস্থায় প্রবেশ করেন, যেখানে ‘অজ্ঞতা ধ্বংস হয়েছিল, জ্ঞানের জন্ম হয়েছিল; অন্ধকার দূর হয়েছিল, আলোয় প্লাবিত হয়েছিল।’
তাৎক্ষণিকভাবে তিনি অনুধাবন করেছিলেন, ‘পুনর্জন্ম আর নয়। আমি সর্বোচ্চ জীবন কাটিয়েছি, আমার কাজ এখন শেষ, আর এখন আমি যা ছিলাম, সেটির আর কোনো অস্তিত্ব নেই।’ সামসারার চক্রের ঘূর্ণন আর পুনর্জন্ম তার জন্যে থেমে গিয়েছিল। আর তখন তিনি বুদ্ধে পরিণত হয়েছিলেন ‘যিনি পরম শাশ্বত বোধ বা জ্ঞান লাভ করেছেন।’ যেদিন সর্বতৃষ্ণার ক্ষয় সাধন করে তিনি বোধিজ্ঞান লাভ করে বুদ্ধ হয়েছিলেন, সেটি মহাপবিত্র রাত্রি নামে পরিচিত (বুদ্ধ পূর্ণিমা)। উনপঞ্চাশ দিন ধরে ধ্যান করার পর তিনি বোধিপ্রাপ্ত হন। এই সময় তিনি মানবজীবনে দুঃখ ও তার কারণ এবং দুঃখ নিবারণের উপায় সম্বন্ধে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেন, যা ‘চতুরার্য সত্য’ নামে খ্যাত হয়। তার মতে এই সত্য সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করলে মুক্তি বা নির্বাণ লাভ সম্ভব।