সিদ্ধার্থ ছিলেন রাজা আর যোদ্ধাদের ক্ষত্রিয় বর্ণের একজন সদস্য। তার পিতা শুদ্ধোদনের, শাক্য রাজ্যের রাজা (শাক্য প্রজাতন্ত্রের নির্বাচিত প্রধান), বয়স যখন পঞ্চাশ, তখন তার স্ত্রী রানী মায়া (মায়াদেবী) তাদের এই পুত্রসন্তানটির জন্ম দিয়েছিলেন। একজন ধর্মপ্রাণ শিশু হিসাবে, সিদ্ধার্থ হিন্দুধর্মের পবিত্রতম গ্রন্থ বেদ অধ্যয়ন করেছিলেন। এবং যদিও তিনি রাজকুমার ছিলেন, যিনি কিনা বিশেষভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত বিলাসী একটি জীবন কাটাতেন, তার শিক্ষকরা কিন্তু তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, বহু জীবনের সেই জন্মজন্মান্তর চক্রের দীর্ঘ একটি যাত্রায় বাকি আর সবার মতোই তিনিও একজন যাত্রী। তার বয়স যখন ষোলো, তিনি রাজকুমারী যশোধরাকে বিয়ে করেছিলেন, এবং তাদের একটি পুত্রসন্তান হয়েছিল, রাহুল। উনত্রিশ বছর বয়স অবধি সিদ্ধার্থ সুরক্ষিত আর বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত একটি জীবন কাটিয়েছিলেন, তার প্রতিটি প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্যে ছিল রাজভৃত্যদের একটি বিশাল বাহিনী। কিন্তু অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে ধারাবাহিকভাবে ঘটা কিছু ঘটনা চিরকালের জন্যে তার জীবনটাকে বদলে দিয়েছিল। সে-ঘটনাগুলো চার নিমিত্ত দর্শনের কাহিনি (স্টোরি অব ফোর সাইটস) হিসাবে পরে পরিচিতি পেয়েছিল।
প্রথম দিনে, দিনের শেষে শিকার থেকে ফেরার পথে, সিদ্ধার্থ একজন রোগজীর্ণ রুগ্ণ ব্যক্তিকে মাটিতে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখেছিলেন। তিনি তার দেহরক্ষী ও সারথি ছন্নকে (ছন্দক) জিজ্ঞাসা করছিলেন এই লোকটির কী হয়েছে। ‘লোকটি অসুস্থ’, এটাই ছিল উত্তর। রাজকুমার জিজ্ঞাসা করেন, ‘কেন সে অসুস্থ’? ‘রাজকুমার, এটাই জীবনের নিয়ম। সব মানুষই অসুস্থ হবে’। রাজকুমারকে দেখে মনে হয়েছিল তিনি কিছু ভাবছেন, কিন্তু আর কিছু বলেননি।
পরের দিন, ধনুকের মতো বাঁকা পিঠসহ একজন বৃদ্ধকে তিনি দেখেছিলেন, তার মাথা আর হাত ছিল কম্পমান। এমনকি দুটো লাঠির উপর ভর করেও তার জন্যে, হাঁটা স্পষ্টতই বেশ কষ্টকর অনুভূত হয়েছিল। ‘ঐ মানুষটাও কি অসুস্থ?’ রাজকুমার ছন্নকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। ‘না’, ছন্ন উত্তর দিয়েছিলেন, ‘উনি বৃদ্ধ, বৃদ্ধবয়সে সব মানুষের সাথে এমনই হয়’। রাজকুমারকে দেখে মনে হয়েছিল তিনি কিছু ভাবছেন, কিন্তু আর কিছু তিনি বলেননি।
তৃতীয় দৃশ্য ছিল একটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার যাত্রা। একজন মৃত মানুষকে শ্মশানে দাহ করতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল হিন্দুধর্মের নিয়মানুযায়ী, এবং মৃতের ক্রন্দনরত বিধবা স্ত্রী আর সন্তানরা সেটি অনুসরণ করছিলেন। সিদ্ধার্থ ছন্নকে প্রশ্ন করেছিলেন, কী হচ্ছে এখানে। ‘এটি সব রক্ত-মাংস দিয়ে গড়া মানুষের নিয়তি’। তিনি ব্যাখ্যা করেন, রাজকুমার কিংবা ভিক্ষুক, আমাদের সবার জন্যেই মৃত্যু আসবে। আবারও সিদ্ধার্থ কোনো উত্তর দিলেন না।
সিদ্ধার্থ অসুখ, বার্ধক্য আর মৃত্যুর দুঃখের সাক্ষী হয়েছিলেন। ‘এইসব দুঃখের কারণ কী?’ তিনি ভাবতে শুরু করেছিলেন। তিনি বেদ পড়েছিলেন, কিন্তু সেটি তাকে যা বলেছিল সেটি হচ্ছে, এটাই জীবনের নিয়ম, এটাই হচ্ছে কার্মা। যখন তিনি তার প্রাসাদে বসে এইসব রহস্যগুলো নিয়ে ভাবছিলেন, একটি গানের শব্দ জানালা দিয়ে তার কান অবধি ভেসে এসেছিল। কিন্তু সেটি তাকে আরো বিষণ্ণ করে তুলেছিল। আনন্দ সাময়িক, তিনি অনুধাবন করেছিলেন। এটি স্বস্তি দেয় কিন্তু মৃত্যুর ক্রমশ এগিয়ে আসাটিকে মন্থর করার জন্যে কিছুই করতে পারে না।
চতুর্থ দিনে তিনি একটি বাজারে গিয়েছিলেন, যথারীতি ছন্নও ছিল তার সাথে। দোকানি আর ব্যবসায়ীদের মধ্যে, যারা ক্রেতাদের সব প্রয়োজন পূরণ করেন, সিদ্ধার্থ মোটা কাপড়ের জামা পরা একজন সন্ন্যাসীকে দেখেছিলেন, যিনি খাদ্যের জন্যে সবার কাছে ভিক্ষা প্রার্থনা করছিলেন। তিনি বৃদ্ধ এবং স্পষ্টতই দরিদ্র, কিন্তু তারপরও তাকে দেখতে সুখী আর প্রশান্তিময় মনে হয়েছিল। ‘এটি কেমন ধরনের মানুষ’? তিনি ছন্নকে আবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন। ছন্ন ব্যাখ্যা করেছিলেন, ‘তিনি সেই মানুষগুলোর একজন, যারা গৃহত্যাগ করেছেন নিজস্ব কোনো সম্পদ আর মায়া ছাড়া বাঁচতে, সংসার যে মোহের সৃষ্টি করে সেটি থেকে মুক্তি পেতে।’
গভীর চিন্তা নিয়েই সিদ্ধার্থ তার প্রাসাদে স্বাচ্ছন্দ্যে ফিরে আসেন। সেই নিদ্রাহীন আর অস্থির রাতে একটি অনুধাবন তাকে আমূল নাড়িয়ে দিয়েছিল, সেটি হচ্ছে আসলেই তৃষ্ণাই (কামনা কিংবা বাসনা) হচ্ছে সব মানব-দুঃখের মূল কারণ। নারী ও পুরুষ কখনোই কেউ তাদের ভাগ্য নিয়ে সন্তুষ্ট নয়, কখনোই তারা শান্তিতে নেই। তারা সেটাই কামনা করে, যা তাদের নেই। কিন্তু যখনই তাদের সেই কাঙ্ক্ষিত দ্রব্যটি অর্জন করা হয়ে যাবে, সেই জায়গায় নতুন আরো একটি কামনাও জেগে উঠবে। আর বিষয়টি নিয়ে যতই তিনি ভাবছিলেন, ততই এই কামনাগুলো তার অসহ্য মনে হয়েছিল, তীব্র বিতৃষ্ণা তিনি অনুভব করেছিলেন। এই পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া প্রতিটি সত্তাকে আক্রান্ত করে এটি এমন একটি অসুখ, এই বাধ্যবাধকতা থেকে পালানোর কোনো উপায় নেই। যদিও কামনা তাকে বিতৃষ্ণ করে তুলেছিল, কিন্তু সেই মানুষগুলোর প্রতি সহমর্মিতায় তার হৃদয় পূর্ণ। হয়েছিল, যাদের এটি নিরন্তর নিপীড়ন করছে। তখনই তিনি তাদের সহায়তা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি তাদের জন্যে একটি উপায় খুঁজে বের করবেন, যেন তৃষ্ণার এই কারাগার থেকে তারা মুক্তি পেতে পারে, যেন তাদের আর এই দুঃখময় পৃথিবীতে কখনোই জন্ম নিতে না হয়। তিনি সেই জ্ঞানের অনুসন্ধান করবেন যা তাকে পুনর্জন্ম চক্রের অনন্ত ঘূর্ণন থেকে মুক্তি দেবে। তারপর তিনি অন্যদের তার সেই খুঁজে-পাওয়া পথটি প্রদর্শন করবেন।