সেকুলার মানবতাবাদীরা যে-কোনো গোষ্ঠীর সাথে কাজ করতে আগ্রহী, যারা এই পৃথিবীকে আরো উত্তম বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করছেন, যাদের মধ্যে ধর্মবিশ্বাসীদের গোষ্ঠীও অন্তর্ভুক্ত। তারা এমনকি ধর্মের কিছু পোশাকি রূপও চুরি করতে প্রস্তুত আছেন। মানবতাবাদীরা সচেতন যে, ধর্মের এই ক্ষয়িষ্ণু পরিস্থিতির সাথে সংশ্লিষ্ট বহু ভালো জিনিসই হারিয়ে গেছে, সুতরাং তারা সর্বোচ্চই চেষ্টা করছেন যেন সেগুলো অন্তত কিছু পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয় এবং সেগুলোকে মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যবহার করা যায়। মানবজীবনের বড় ক্রান্তি লগ্নগুলোকে চিহ্নিতকরণে সহায়তা করতে ধর্ম খুবই দক্ষ। জন্ম, বিয়ে, মৃত্যু, এইসব ঘটনাগুলো উদ্যাপনে ধর্মের নানা অনুষ্ঠান আছে। সমস্যা হচ্ছে এই অনুষ্ঠানগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট আছে স্বর্গীয় জগৎ, যে-জগৎটিকে সেকুলার মানবতাবাদীরা বিশ্বাস করেন না। শিশুদের শরীর থেকে পাপ পরিষ্কার করতে হবে, দম্পতিদের বলতে হবে বিয়ে সারাজীবনের জন্যে, তারা সেটি চান বা না চান। এবং মৃতরা সবাই অন্য একটি জীবনে প্রবেশ করবেন–মানবতাবাদীরা এসব কিছু বিশ্বাস করেন না।
সুতরাং তাদের নিজেদের অনুষ্ঠানের ভাষা তারা নিজেরাই লিখতে শুরু করেছিলেন। এবং আধুনিক সেকুলার-রাষ্ট্র সেটি পরিচালনা করার জন্যে তাদের অনুমতিও দিয়েছে। স্কটল্যান্ডে এখন হিউম্যানিস্ট সেলেব্রান্ট বা মানবতাবাদী অনুষ্ঠান-পরিচালনাকারীরা খ্রিস্টীয় যাজকদের মতোই প্রায় একই সংখ্যক বিয়ের অনুষ্ঠান পরিচালনা করছেন। তারা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া আর শিশুদের নামকরণ-অনুষ্ঠানও পরিচালনা করেন। এই অনুষ্ঠানগুলো যারা অনুরোধ করেছেন তাদের চাহিদামতো সাজাতে, তারা এখন যথেষ্ট পরিমাণ দক্ষতাও অর্জন করেছেন। একজন মানবতাবাদী সেলেব্রান্ট, তাদের নিজস্ব মূল্যবোধ আর পছন্দগুলো সেই অনুষ্ঠানের সাথে যুক্ত করতে সহায়তা করেন। এর সেটি করার মাধ্যমে এই অনুষ্ঠানগুলো একটি ব্যক্তিগত তাৎপর্য লাভ করে। তারা ভিন্নধরনের একটি আধ্যাত্মিকতা জীবনের সেই মুহূর্তগুলোর সাথে যুক্ত করতে পারেন, যা একসময় একচেটিয়াভাবে গতানুগতিক ধর্মগুলোর নিয়ন্ত্রণে ছিল। সেকুলার আধ্যাত্মিকতা এই জীবনেই এর অর্থ আর সৌন্দর্য খুঁজে পায়। এটি একমাত্র জীবন যা আমরা কখনো উপভোগ করতে পারব, সুতরাং এর জন্য আমাদের কৃতজ্ঞতা অনুভব করা উচিত এবং এটি উত্তমভাবে ব্যবহার করা উচিত।
আর ধর্ম থেকে সেকুলার মানবতাবাদীরা শুধু এটাই ঋণ করেননি, যেভাবে বিশ্বাসী মানুষরা একই সাথে উপাসনার জন্যে একত্র হন এবং পরস্পরের সান্নিধ্যে আসার এই অভিজ্ঞতাটিকে তারা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। কারণ এই অনুষ্ঠানগুলো মানুষদের মধ্যে সংমিশ্রণ করে, পরস্পরকে সহযোগিতা করার সুযোগ সৃষ্টি করে, অন্যথায় যাদের হয়তো কখনোই দেখা হতো না। উপাসনায় সাপ্তাহিক হাজিরা কী-ধরনের জীবন আপনি কাটাচ্ছেন সে-বিষয়ে আন্তরিক হতে এবং গভীরভাবে নিরীক্ষণ করতে, আর হয়তো কিছু পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেবার একটি সুযোগ সৃষ্টি করে। সেকুলার মানবতাবাদীরা এটির গুরুত্ব অনুধাবন করেছেন। সুতরাং তারা তাদের নিজস্ব সংস্করণে রোববারের সমাবেশ সৃষ্টি করেছেন। মাঝে মাঝে এটি পরিচিত চার্চ-গোয়িং ফর অ্যাথেইস্ট’ নামে, যেখানে তারা সেকুলার বক্তৃতা আর উপদেশ শোনেন, এবং সমবেতভাবে গান গেয়ে থাকেন। এর সাথে তারা কিছু মুহূর্তের নীরবতা আর ব্যক্তিক আত্মবীক্ষণের সময়ও যুক্ত করেছেন। এটি অতিপ্রাকৃত কোনোকিছু ছাড়াই ধর্ম : মানবধর্ম।
তবে এই ধরনের মানবতাবাদ কি টিকে থাকতে পারবে, আরো বিকশিত হবে, নাকি একসময় ম্লান হয়ে হারিয়ে যাবে? সেই বিষয়ে এখনো ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো যথেষ্ট সময় অতিক্রান্ত হয়নি। সেকুলার ধর্ম প্রতিষ্ঠা করার জন্যে এর আগেও চেষ্টা করা হয়েছিল, এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যে সেটি হারিয়েও গিয়েছিল। সমালোচকরা সবসময়ই বলেন, এগুলো হচ্ছে অ্যালকোহলমুক্ত বিয়ার কিংবা ক্যাফেইন-বিহীন কফি পান করার মতো। এমন কিছু করারই বা কী অর্থ থাকতে পারে?
এইসব কিছু সেকুলার-মানসিকতাসম্পন্ন মানুষদের জন্য একই সাথে ধর্মের আকর্ষণ এবং এর সমস্যাগুলোর প্রমাণ দিচ্ছে। তারা হয়তো ধর্ম যা-কিছু অর্জন করেছে, তার প্রশংসা করতে পারেন, কিন্তু তারা সেই অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসকে আর মেনে নিতে পারেন না, যার ওপর ভিত্তি করে এটি দাঁড়িয়ে আছে। কর্তৃত্বের সেই রূপগুলো নিয়ে তারা সন্দিহান, যা দাবি করে এটি মানব-সংশোধনের ঊর্ধ্বে এবং অভ্রান্ত। তারা লক্ষ করেছেন, মানব-আচরণের ভালো পরিবর্তনগুলোর সাথে খাপ খাইয়ে নেবার ক্ষেত্রে, আর নতুন জ্ঞানের পরিণতিগুলো মেনে নিতে ধর্ম কতটা মন্থর। নতুন কিছু জানার মতো সাহসী হওয়ার বদলে ধর্ম সাধারণত প্রাচীন ধারণাগুলো আঁকড়ে ধরে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
আমরা যেমন ইতিমধ্যেই লক্ষ করেছি, ধর্ম হচ্ছে সেই কামারের নেহাই, যা বহু হাতুড়িক্ষয়ের কারণ হয়েছে। এটি হয়তো সেকুলার-মানবতাবাদের চেয়ে আরো বেশিদিন টিকে থাকতে পারে। যদিও আজ বহু জায়গায় এটি ক্রমশ হারিয়ে যাবার মুখে, কিন্তু এটি এখনো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী এবং আপনার কাছেই উপাসনা করার কোনো স্থানে এটি এখনো চলমান। তবে সেই অনুষ্ঠানের টিকিট আপনি কাটবেন কিনা সেটি পুরোপুরিভাবে আপনার ওপরেই নির্ভর করবে।