হিন্দু দেবতারা কেমন দেখতে সেটি যদি আপনি জানতে চান, তাহলে তাদের খুঁজতে কোনো মন্দিরে আপনাকে প্রবেশ করতে হবে। সুতরাং আসুন আমরা সবচেয়ে নিকটবর্তী একটি মন্দির খুঁজে বের করি। প্রথমে আমরা সিঁড়ি বেয়ে একটি চাতালে পৌঁছাব, সেখানে আমাদের জুতা খুলে রেখে খালিপায়ে মন্দিরে প্রবেশ করতে হবে। আমরা মূল হলঘরে আসব, সেখানে একপ্রান্তে সিঁড়ি দিয়ে বাঁধানো উঁচু বেদির উপর একটি বা কয়েকটি দেবতার মূর্তি আবিষ্কার করব, যারা সেখানে বাস করেন। ভারতের বড় মন্দিরগুলো আরো অনেক বেশি মূর্তি দিয়ে পূর্ণ থাকে। তবে অন্য কোনো সাধারণ মন্দিরে হয়তো তিনটি প্রতিমা থাকতে পারে, যে-দেবতারা খুবই জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ।
আপনি হয়তো সেই মূর্তিটি দেখেছেন যেখানে আমরা নৃত্যরত একজন পুরুষকে দেখব, যার তিনটি চোখ আর চারটি হাত আছে, যার মাথা থেকে ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত নদীটি বের হয়ে এসেছে, গঙ্গা। এছাড়া আরেকটি মূর্তিও খুব পরিচিত মনে হতে পারে, যার ভুঁড়িসহ বিশাল একটি মানবশরীর আছে এবং মাথাটি একটি হাতির মাথার মতোই। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে নাড়িয়ে দেবার মতো প্রতিমাটি অবশ্যই নারীদেবীর একটি মূর্তি, তার বিশাল জিহ্বাটি বের হয়েছে, তারও চারটি হাত, তার একটিতে সে ধরে আছে ধারালো তলোয়ার, অন্য হাতে একটি খণ্ডিত মাথা, যেখান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
ঐ নৃত্যরত তিন চোখ আর চার হাতসহ মূর্তিটি হচ্ছে দেবতা শিব, ধ্বংসকারী। হাতির মাথাসহ প্রতিমাটি গণেশ, দেবী পার্বতী আর শিবের পুত্রদের একজন। আর চার হাতের যে-নারীটি খণ্ডিত মস্তিষ্ক হাতে ধরে আছে তিনি হচ্ছেন কালী, শিবের স্ত্রীদের মধ্যে অন্যতম একজন। গণেশের মাথাটি হাতির মতো কারণ একদিন তার বাবা তাকে চিনতে না পেরে ভুল করে মাথাটি কেটে ফেলেছিলেন। তার ভুল-বোঝার পর প্রথম যে প্রাণীর দেখা পাবেন তার থেকে নতুন একটি মাথার প্রতিস্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ঘটনাক্রমে সেই প্রাণীটি ছিল হাতি। এই ধরনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা সহ্য করেছিলেন যিনি, তার জন্য মানানসই পরিমাণে গণেশ খুব জনপ্রিয় আর কাছের দেবতা, যিনি তার অনুসারীদের জীবনের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সহায়তা করেন।
কালীর কাহিনিটি অপেক্ষাকৃত কম-সান্ত্বনাদায়ক। হিন্দুধর্মের দেবতারা তাদের বাহ্যিক রূপ পরিবর্তন করার ব্যাপারে খুবই দক্ষ। এবং কালী হচ্ছে মা দেবীর বহু রূপের একটি, দেবতার রমণীয় দিকের একটি অংশ। অশুভের সাথে তার বহু যুদ্ধের একটিতে কালী ধ্বংসলীলায় এতটাই বেশি মত্ত হয়ে পড়েছিলেন, এবং তিনি তার সামনে আসা সবকিছুকেই জবাই করতে শুরু করেছিলেন। তার এই উন্মত্ততা থামাতে, শিব নিজেকে তার পায়ের উপর ছুঁড়ে মেরেছিলেন, এবং কালী তার এই আচরণে এতটাই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন যে, বিস্ময়ে তার জিহ্বা বের হয়ে এসেছিল। কালী আর গণেশ বেশ বর্ণিল দুটি চরিত্র, কিন্তু শিব আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দুদেবতাদের বিশাল ভাণ্ডারে তিনি স্মরণীয় তিন সর্বোচ্চ দেবতাদের একজন, অন্য দুইজন হচ্ছেন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, যার সাথে আমাদের আগেই দেখা হয়েছে এবং বিষ্ণু, যিনি রক্ষক।
হিন্দুধর্মে এই তিন প্রধান দেবতার অবস্থান কোথায় সেটি বুঝতে হলে, সময় নিয়ে ভিন্ন দুটি উপায়ে ভাবনার বিষয়টি প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে। পশ্চিমা চিন্তায় সময় চলে কোনো নিশানা বরাবর ধনুক থেকে ছোঁড়া তীরের মতো, যা নিশানার দিকে ছুটে চলে, তাহলে এর সবচেয়ে সেরা চিত্রটি হবে একটি সরলরেখার মতো, যা সামনে ধাবমান (à) ভারতীয় ভাবনায় সময়চক্র বা বৃত্তাকার চাকার মতো ঘূর্ণায়মান, সুতরাং এর সবচেয়ে ভালো প্রতীকী রূপ হবে একটি বৃত্ত (০)। ঠিক যেভাবে কার্মা প্রতিটি মানুষকে পুনর্জন্মের নিরন্তর চক্রের মধ্যদিয়ে পরিচালিত করে, মহাবিশ্বও সেই একই নিয়মে বন্দি। বর্তমান সময়ের শেষে এটি শুন্যতার শূন্যতায় ম্লান হয়ে মিলিয়ে যায়, যতক্ষণ-না ‘সেই একক সত্তা’ সময়ের চাকাটি আবার ঘোরানো শুরু করেন, এবং ব্রহ্মা আরেকটি মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেন।
পরবর্তী চাকা-ঘোরানো অবধি তার কাজ শেষ হলে, ব্রহ্মা বিশ্রাম নেন এবং বিষ্ণু এই মহাবিশ্বের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেন। বিষ্ণুকে তার ডানহাতে কর্তৃত্বের প্রতীক হিসাবে একটি গদাসহ আঁকা হয়, তিনি হলেন সেই দেবতা যিনি দয়াময় পিতার মতো মহাবিশ্বের প্রতিপালন করেন এবং এটিকে সুরক্ষিত রাখতে কঠোর পরিশ্রম করেন। বিষ্ণু আমাদের আশ্বস্ত করেন ও স্বস্তি দেন, হয়তো তাকে খানিকটা ক্লান্তিকর নীরস অনুভূত হতে পারে। শিব অবশ্যই বর্ণিল একটি চরিত্র, তিনি মানবচরিত্রের যুদ্ধপ্রিয় দিকটির প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি ধ্বংসকারী, ব্রহ্মা যা শুরু করেছিলেন, তিনি সেটি শেষ করেন এবং বিষ্ণু সেটি প্রতিপালন করেন। তার সবচেয়ে নাটকীয় কর্মটি হচ্ছে তাণ্ডবনৃত্য বা ড্যান্স অব ডেথ, তাণ্ডব ধ্বংসাত্মক ও পুরুষালি নৃত্য; শিব কাল-মহাকাল বেশে বিশ্বধ্বংসের উদ্দেশে এই নাচ নাচেন, তিনি সময় আর মহাজগৎকে তার পায়ের নিচে পাড়িয়ে ধ্বংস করেন, চাকার পরবর্তী ঘূর্ণন অবধি, যখন ব্রহ্মা আবার আরেকটি মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেন।