যেমন, আমরা দেখেছি, বহু ধর্মই নারীদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করে থাকে। সেই ধর্মগুলোর পবিত্র বইটি বলেছে যে, ঈশ্বর নারীদেরকে পুরুষদের সহায়তাকারী হিসাবে সৃষ্টি করেছেন এবং পুরুষের ওপর কখনোই তারা কর্তৃত্ব অনুশীলন করতে পারবে না। সেকুলার সমাজগুলোয় নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করাটিকে একটি নৈতিক ভ্রান্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এবং কিছু ক্ষেত্রে এটিকে অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং যার জন্যে আপনাকে আদালতের সামনে হাজির করা হতে পারে। তা সত্ত্বেও, সেকুলার মূলনীতি অনুযায়ী, যা ধর্মকে এর নিজস্ব সহবিশ্বাসীদের সমাজে তার নিজের ইচ্ছামতো কাজ করার স্বাধীনতা দিয়েছে, এবং রাষ্ট্র মাঝে মাঝে ধর্মীয় সমাজগুলোর আচরণের প্রতি অন্ধদৃষ্টি প্রদান করে, যা মূল সমাজে একটি অপরাধ বলেই গণ্য হবে।
অন্য উদাহরণটি সমকামিতা সংক্রান্ত। আবারো, ধর্মের পবিত্র বইগুলো এটি অনুমোদন করেনি। সমকামিতা সবসময়ই পাপ এবং এমন পাপ, যার জন্যে আপনাকে হত্যা করাও হতে পারে। পৃথিবীর বেশকিছু জায়গায় আজও, এটি আপনার মৃত্যুর কারণ হতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ আধুনিক সেকুলার সমাজগুলোয় সমকামীদের নিপীড়ন করাই এখন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিষমকামীদের মতো সমকামীদের এখন একই অধিকার দেওয়া হয়েছে, এবং কিছু দেশে, তাদের বিয়ে করারও অধিকার আছে। কিন্তু তারপরও সেকুলার-রাষ্ট্র সমকামীদের প্রতি প্রদর্শিত বৈষম্যগুলো দেখেও না-দেখার ভান করে, বহুধর্মবিশ্বাসীদের সমাজে যে-বৈষম্যটি এখনো অনুশীলন করা হচ্ছে।
যদিও সেকুলার-রাষ্ট্র হয়তো ধর্মবিশ্বাসী গোষ্ঠীগুলোর সেক্সিজম বা যৌনবৈষম্যবাদ আর সমকামিতাকে অবজ্ঞা করতে পারে, কিন্তু এর বহু নাগরিকই যথেষ্ট পরিমাণ মনোযোগ দিয়ে বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করেন এবং তারা যা দেখছেন সেটি পছন্দ করেন না। কারণ, সেকুলার রাষ্ট্রের আবির্ভাবের সাথে এনলাইটেনমেন্ট সেকুলার মনেরও জন্ম দিয়েছিল, জীবন সম্বন্ধে ভাবার একটি উপায়, যা কীভাবে এই পৃথিবী সংগঠিত হবে সেই বিষয়ে ঈশ্বর আর তার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি কোনো তথ্যনির্দেশ করে না। এর নিজের জীবনে ধর্মীয় মূলনীতিগুলোর প্রয়োগ প্রত্যাখ্যান করা ছাড়াও সেকুলার মন আরো কিছু করে। অন্যদের জীবনের ওপর ধর্ম কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে সেটি দেখে এটি বিতৃষ্ণ। সেই প্রান্তিক ব্রোঞ্জ-যুগ থেকে আসা পবিত্র লেখার ওপর ভিত্তি করে যারা নারী এবং সমকামীদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করে, এটি তাদের বিরোধিতা করে। পশ্চিমে সেকুলার মনের আবির্ভাবে ধর্মের কর্তৃত্বের ধীর ক্ষয়ের কারণ হয়েছে। পরিণতিতে খ্রিস্টধর্ম, যে-বিশ্বাসটি বহু শতাব্দী ধরে ইউরোপ প্রাধান্য বিস্তার করেছিল, সেটি ক্রমশ দুর্বলতর হতে শুরু করেছিল এবং উত্তরোত্তর শক্তিক্ষয়ের এই প্রক্রিয়াটি থামার খুব সামান্যই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এই শক্তিক্ষয় বহু মানুষকে বিমর্ষ করেছে, এর মধ্যে কিছু মানুষ যারা নিজেরাই ধর্ম অনুশীলন করা বন্ধ করে দিয়েছেন। তারা জানেন ইতিহাসে এর দীর্ঘযাত্রায় বহু অনাচার চার্চের অংশে পরিণত হয়েছিল, কিন্তু এছাড়াও এর কিছু সদগুণও আছে সেই বিষয়টি তারা স্বীকার করেন। এটি মানবতার মিত্র যেমন ছিল তেমনি শত্রুও ছিল; নিরাময়কারী আবার একই সাথে একজন নিপীড়ক। কিন্তু মানবপ্রকৃতি কোনো একটি শূন্যতা ঘৃণা করে। সুতরাং পশ্চিমে ম্লান হয়ে যেতে থাকা খ্রিস্টধর্মের ফেলে-যাওয়া শূন্যস্থানটি ‘সেকুলার হিউম্যানিজম’ নামে একটি নতুন আন্দোলনের সূচনা করতে প্ররোচিত করেছিল। যদিও সেকুলার হিউম্যানিজম বা মানবতাবাদ ধর্মের সংজ্ঞায় উত্তীর্ণ হতে পারবে না, কিন্তু যেহেতু এটি ধর্ম থেকে বেশকিছু সেরা ধারণা ঋণ করেছে, এটি নিয়ে খানিকটা পর্যালোচনা এই ইতিহাস শেষ করার একটি ভালো উপায় হতে পারে।
নামটি যেমন প্রস্তাব করছে, সেকুলার মানবতাবাদীরা মানুষকে একটি সুন্দর জীবন কাটাতে সহায়তা করার চেষ্টা করেন, তবে সেটি ধর্মের আরোপ করা মূলনীতি অনুসারে নয় বরং সেই মূলনীতি অনুযায়ী, যা মানুষ নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্দিষ্ট করেছে। তারা বিশ্বাস করেন মানবতা প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে এবং এখন এর নিজের দায়িত্ব নিজেরই নেওয়া উচিত। মানবতার শৈশবে ধর্ম, অথবা ঈশ্বর বলেছিলেন, কী করতে হবে আর কী করা যাবে না, এবং সেখানে হতবাক করে দেবার মতো কিছু নির্দেশাবলি ছিল। দাসত্ব, নারীনিপীড়ন, সমকামীদের পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা, বাধ্যতামূলক ধর্মান্তরিতকরণ এবং ভুল ধর্মবিশ্বাস করার কারণে শাস্তি। অবশ্যই এখন তারা এর চেয়ে উত্তম কিছু করতে সক্ষম। আর নিজেরাই যেহেতু মানুষ, মানবতার জন্যে কোটি ভালো সেটি জানার জন্যে তারা শ্রেষ্ঠ একটি অবস্থানে আছেন। সহিষ্ণুতা অবশ্যই উত্তম। নির্যাতন অশুভ এবং বর্জনীয়। দয়া উত্তম এবং নিষ্ঠুরতা অগ্রহণযোগ্য এবং অশুভ। আর এটি বোঝার জন্যে আপনাকে কোনো ঈশ্বরকে বিশ্বাস করতে হবে না। প্রতিবেশীদের ভালোবাসা আর নিজের সাথে যেভাবে আচরণ করা হোক বলে আপনি প্রত্যাশা করেন, সেভাবেই প্রতিবেশীদের সাথে আচরণ করা, এই বিষয়গুলোর ব্যাপারে আপনাকে নির্দেশ দেবার জন্যে কোনো ধর্মেরই প্রয়োজন নেই।