আর ইতিহাসে ডেইজিই একমাত্র প্রাণী নয় যাদের মস্তিষ্কে এই HADD বিবর্তিত হয়েছে। বহু শতাব্দী ধরেই প্রায় পুরো মানবতাকে এটি প্রভাবিত করেছে। ধর্ম এই পৃথিবীর মানুষকে বলেছে কোনো প্রাকৃতিক সূত্র বা আইন নয় বরং অতিপ্রাকৃত শক্তিগুলো এই পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আর এই ধারণাকে ব্যাখ্যা করে যে-শব্দটি, সেটি হচ্ছে ‘কুসংস্কার’, সেই বিশ্বাসটি, প্রাকৃতিক কোনো কারণ ছাড়াই জাদুর মাধ্যমে কোনোকিছু ঘটতে পারে। আর এইভাবে চিন্তা করার উপায়টিতে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছিল সপ্তদশ শতাব্দীতে একটি পর্বের সময়, যা এখন ‘এনলাইটেনমেন্ট’ নামে পরিচিত, যখন এই পৃথিবীতে যা ঘটছে। সেটি ব্যাখ্যার শ্রেষ্ঠতম উপায় হিসাবে বিজ্ঞান কুসংস্কারকে প্রতিস্থাপিত করেছিল। যা-কিছু ঘটে তার একটি কারণ আছে। এনলাইটেনমেন্ট-পর্বের মূলমন্ত্র ছিল ‘জানতে সাহসী হয়ে উঠুন’। কুসংস্কারের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন না। কোনো জিনিসের সত্যিকারের কারণটি জানার মতো সাহস করুন। এনলাইটেনমেন্ট পর্বের একটি পরিণতি ছিল মানুষের মনের ওপর অতিপ্রাকৃতিক কুসংস্কাচ্ছন্ন যে ব্যাখ্যাগুলো দৃঢ়ভাবে তাদের প্রভাব ধরে রেখেছিল, সেটি ক্রমশ শিথিল হতে শুরু করেছিল। মানুষের মস্তিষ্কে আলো প্রবেশ করেছিল এবং তারা নিজেরাই চিন্তা করতে শুরু করেছিলেন।
যদি প্রকৃতি কীভাবে কাজ করে সেটি জানতে চাইবার সাহস এনলাইটেনমেন্ট পর্বের অন্যতম একটি তাড়না হয়ে থাকে, তাহলে আরেকটি ছিল বহু শতাব্দী ধরে অব্যাহত ধর্মীয় সহিংসতার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ। কুসংস্কার অবশ্যই যথেষ্ট পরিমাণে খারাপ, কিন্তু তার চেয়েও খারাপ হচ্ছে যুদ্ধ। এনলাইটেনমেন্ট পর্বের চিন্তাবিদরা লক্ষ করেছিলেন, ধর্মগুলো কীভাবে সবসময়ই পরস্পরের বিরোধী একটি অবস্থানে থাকে। প্রতিটি ধর্মই মনে করে, একমাত্র তারাই ঈশ্বর-প্রেরিত সত্যটিকে ধারণ করছে, এবং বাকিরা সব প্রতারণা করছে ভ্রান্ত বিশ্বাস ফেরি করে। যখন ধর্ম কোনো-একটি দেশের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পায়, এটি এর নির্দেশমতো চলতে নির্বিশেষে সবাইকে বাধ্য করার চেষ্টা করে। এটি যথেষ্ট পরিমাণ খারাপ একটি পরিস্থিতি। কিন্তু পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়, যখন একটি দেশে মাত্র দুটি ধর্ম পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতা করে। প্রায় সারাক্ষণই তারা পরস্পরের সাথে সহিংস বিবাদে লিপ্ত থাকে, ঠিক যেভাবে রিফরমেশন-পর্বের সেই সময় থেকে ইউরোপেও একই পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল। কিন্তু যদি সেখানে ত্রিশটি ধর্ম থাকে তাহলে যেন মনে হয় তারা সবাই শান্তিতে বসবাস করছেন।
এনলাইটেনমেন্ট এখান থেকে দুটি উপসংহারে পৌঁছেছিল। প্রথমটি ছিল, যত বেশিসংখ্যক ধর্ম একটি সমাজে থাকবে, সেই সমাজ সবার জন্যে অপেক্ষাকৃত বেশি নিরাপদ হবে। সুতরাং শান্তির জন্যে সবচেয়ে সেরা নিশ্চয়তাটি হচ্ছে সবধরনের বৈষম্যকে অবৈধ ঘোষণা করা এবং সহিষ্ণুতার অনুশীলন করা। দ্বিতীয় উপসংহারটি ছিল, যদিও কোনো একটি সমাজে ধর্মের উপস্থিতি সহ্য করা উচিত, কিন্তু কখনোই এটিকে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ দেওয়া উচিত হবে না। ধর্মীয় নেতাদের কর্তৃত্ব শুধুমাত্র তাদের ধর্মবিশ্বাসী গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত।
একসময় শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রে এই মূলনীতিটি কঠোরভাবে আরোপ করা হয়েছিল। আমেরিকার সংবিধানের রচয়িতারা ধর্ম নিয়ে এনলাইটেনমন্ট-পর্বের চিন্তাবিদদের ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তারা স্মরণ করেছিলেন কীভাবে আমেরিকার প্রথম বসতিস্থাপনকারীরা ইউরোপের ধর্মীয় নিপীড়ন থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। এবং তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন এমন কিছু যেন তাদের প্রতিশ্রুত দেশে পুনরাবৃত্ত না হয়। আর সে-কারণে টমাস জেফারসন, স্বাধীনতার ঘোষণার অন্যতম স্থপতি এবং তরুণ প্রজাতন্ত্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট, আমেরিকার জনগণকে উপদেশ দিয়েছিলেন, এমন কোনো আইন প্রণয়ন না করতে, যা কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে শ্রদ্ধা করবে অথবা তাদের বিশ্বাসের স্বাধীন অনুশীলনকে নিষিদ্ধ করবে। তাদের উচিত হবে পার্থক্যের একটি দেয়াল নির্মাণ করা, যা চার্চ আর রাষ্ট্রকে পৃথক রাখবে। আর এটাই যুক্তরাষ্ট্রে ভিত্তিমূলক মূলনীতিগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছিল।
ইউরোপে পরিস্থিতি আরো বেশি জটিল ছিল, যেখানে বহু শতাব্দী ধরে রাষ্ট্র আর চার্চ পরস্পর সম্পৃক্ত ছিল। কিন্তু এনলাইটেনমেন্ট-পর্বে মুক্ত হওয়া ধারণাগুলো রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে ধর্মের কর্তৃত্বকে খর্ব করতে শুরু করেছিল। এবং একটি সময়ে রাষ্ট্র এবং চার্চের মধ্যে আরো বৈপ্লবিক একটি বিভাজন অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল, যা এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি ছিল, যেখানে ধর্ম, যদিও এর কোনো আনুষ্ঠানিক অবস্থান নেই, তারপরও এখনো ধর্মের উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সামাজিক আর রাজনৈতিক প্রভাব বিদ্যমান।
ইউরোপে যা ঘটেছিল সেটি হচ্ছে এমন একধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থার আবির্ভাব হয়েছিল, যাদের এখন আমরা বলি ‘সেকুলার বা লোকায়ত (বা ধর্মনিরপেক্ষ) রাষ্ট্র। সেকুলার শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘সিকুলাম’ থেকে, যার অর্থ সময়ের একটি পর্ব। শব্দটি মূলত অনন্ত সময়ের বিপরীতে একটি সময়কে নির্দেশ করছে; এটি চার্চের বিপরীতে পৃথিবী, ধর্মীয় ঐশী প্রত্যাদেশের বিপরীতে মানবচিন্তা বোঝাতে ব্যবহৃত হতে শুরু হয়েছিল। সেকুলার রাষ্ট্র ধর্ম থেকে উদ্ভূত মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে যারা তাদের জীবন পরিচালনা করছেন, তাদের ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ না-করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু এটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, শুধুমাত্র পার্থিব উৎস থেকে উদ্ভূত মূলনীতিগুলোই এর নিজের সিদ্ধান্তগুলোর ভিত্তি হবে। এখানে কিছু উদাহরণ উল্লেখ করলাম যা এখন কীভাবে এটি কাজ করে সেটি বুঝতে সহায়তা করে।