যদি-না আপনি প্রস্তুত থাকেন এমন কিছু বিশ্বাস করতে যে, ঈশ্বর আসলেই কারো প্রতি বেশি পক্ষপাতিত্ব করেছেন, যেমন মানসিকভাবে বিকৃত কোনো স্বেচ্ছাচারী শাসক করে থাকেন, তাহলে এই উভয়সংকট থেকে বের হবার মাত্র দুটি পথ খোলা আছে। প্রথমটি হচ্ছে সিদ্ধান্ত নেওয়া যে, আসলেই ঈশ্বর বলে কিছু নেই। যাকে ঈশ্বর বলা হচ্ছে সেটি আসলে একটি মানব-উদ্ভাবন, অন্য অনেককিছুর সাথে এটি মানবজাতির সহিংসতা প্রীতি আর আগন্তুকদের প্রতি ঘৃণাকে যুক্তিযুক্ত প্রমাণ করতে ব্যবহার করা হয়েছে। ঈশ্বরকে বাতিল করলে মানব-সহিংসতার সমস্যাটি সমাধান হবে না, তবে এটি সহিংসতার একটি অজুহাতকে অপসারণ করবে।
কিন্তু যদি আপনি ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করতে না চান, তাহলে আপনাকে গভীরভাবে বেশকিছু বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। আপনার নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে হবে কোটি হবার সম্ভবনা আসলে বেশি : ঈশ্বর একধরনের নরঘাতী উন্মত্ত চরিত্র, ধর্মগুলো প্রায়শই সেভাবে তাকে অনুধাবন করেছে? অথবা ধর্মই ঈশ্বরকে সম্পূর্ণভাবে ভুল বুঝেছে এবং এর নিজস্ব নিষ্ঠুরতাকে ঈশ্বরের ইচ্ছা বা নির্দেশের সাথে গুলিয়ে ফেলেছে? আপনি যদি এমন কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, ধর্মই খুব সম্ভবত ঈশ্বরকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে, আর আসলে ঈশ্বর সম্পূর্ণ ভিন্ন সেই হিংস্র দানবীয় একটি চরিত্র থেকে, এর প্রচারকরা মাঝে মাঝেই যেভাবে তাকে উপস্থাপন করে থাকেন, তাহলে আপনাকে একটি সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে।
দেখা যাচ্ছে নিরীশ্বরবাদের চেয়ে ধর্মই বরং ঈশ্বরের অপেক্ষাকৃত বড় শত্রু। নিরীশ্বরবাদ দাবি করে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই। যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব থাকে তিনি হয়তো নিরীশ্বরবাদীদের ঔদ্ধত্যে ক্রুদ্ধ হবার চেয়ে বরং মজা পাবেন। হুম, নিরশ্বরবাদীরা খুব শীঘ্রই আমার উপস্থিতি বুঝতে পারবে। কিন্তু যদি ঈশ্বর রক্তপিপাসু কোনো দানব না হয়ে থাকেন তাহলে ধর্মীয় শিক্ষকরা, যারা তাকে তেমন একটি চরিত্রে রূপান্তরিত করেছেন, তাদের আচরণে ঈশ্বরের খুশি হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। সুতরাং আমরা সেই উপসংহারে আসি, যদিও ধর্মগুলো পৃথিবীর কাছে ঈশ্বরের সত্যিকার প্রকৃতি উন্মোচন করেছে বলে দাবি করে থাকে, কিন্তু বহুক্ষেত্রেই এটি আসলেই ঈশ্বরকে তাদের নিজস্ব নিষ্ঠুরতার ঘন কুয়াশার অন্তরালে লুকিয়ে রেখেছে।
আমরা ধর্মগ্রন্থে কখনো কখনো সেই ধারণার আভাসগুলো একনজর দেখতে পাই যে, ধর্মই হচ্ছে ঈশ্বরের সবচেয়ে হিংস্রতম প্রতিদ্বন্দ্বী। আমরা যিশুর শব্দে এটি বর্ণিত হতে দেখেছি, যিনি লক্ষ করেছিলেন, অশুভ কোনো কাজ করতেই শুধুমাত্র ধর্মকে খুব সহজে ব্যবহার করা হয় না, এছাড়াও ভালো অনেক কাজ না করার অজুহাত হিসাবেও এটিকে ব্যবহার করা হয়। আর সেই ধর্ম আসলেই খারাপ, যা-কিনা বাইবেলের গুড সামারিটানের গল্পের সেই যাজক ও তার সহকারীকে রাস্তার ভিন্ন পাশ দিয়ে চলে যেতে প্ররোচিত করে, কারণ ডাকাতের আক্রমণের শিকার হয়ে যে-মানুষটি অসহায় রাস্তায় পড়ে আছে সে ‘তাদের ধর্মের একজন ছিলেন না’!
সুতরাং হ্যাঁ, ধর্ম ইতিহাসে কিছু ভয়াবহ সহিংসতা ঘটিয়েছে এবং এখনো ঘটানো অব্যাহত রেখেছে। এবং হ্যাঁ, এটি ঈশ্বরকে ব্যবহার করেছে তাদের সব অশুভ কর্মকাণ্ডের নায্যতা দিতে। সুতরাং যদি আমরা ঈশ্বর বলতে এই মহাবিশ্বের সেই দয়ালু ক্ষমাশীল সৃষ্টিকর্তাকে বোঝাতে চাই, তাহলে হয় তার কোনো অস্তিত্ব নেই অথবা ধর্ম তাকে বুঝতে সম্পূর্ণভাবেই ব্যর্থ হয়েছে। আর যে-কোনো ক্ষেত্রেই, ধর্ম নিয়ে তাই আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। আবশ্যিকভাবে কিন্তু এর অর্থ এই না যে, আমাদের উচিত হবে এটিকে পুরোপুরিভাবে ত্যাগ করা। আমরা হয়তো ধর্মের সাথে থাকার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারি, তবে সেটি করতে হবে সেই বিনম্রতার সাথে, আর এটি যা অশুভ কাজ করেছে এবং এটি যা ভালো কাজ করেছে সেটি স্বীকার করে নিতে হবে। এটি আমাদের ওপর নির্ভর করবে।
কিন্তু কিছু মানুষ আছেন যারা ধর্মের রক্তপিপাসু ইতিহাসে এতই বিতৃষ্ণ যে, তারা এটিকে প্রশমন এবং নিয়ন্ত্রণ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা এই বইয়ের শেষ অধ্যায়ে দেখব সেটি কীভাবে তারা করেছিলেন।
৪০. ধর্মের সমাপ্তি
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহটি যখন ফিরে আসে, সেই সময়টিকে আমার কুকুর খুবই অপছন্দ করে। যেখানে আমি থাকি তার কাছেই বাগান আর পার্কে মানুষ আতশবাজি ফোঁটায় গভীর রাত অবধি। এই শব্দ শুনে আমার কুকুর ডেইজি ভয়ে কেঁপে ওঠে। আর তাকে আক্রমণ করা এই শত্রুটির কাছ থেকে পালাতে সে আমার স্টাডির কার্পেটে গর্ত খুঁড়তে চেষ্টা করে। অবশ্যই সে কোনো বিপদে নেই, কিন্তু আমি বিষয়টি তাকে বোঝাতে পারব না। তার সেই জিনিসটি আছে যাকে বলা হয়, হাইপারঅ্যাকটিভ এজেন্সি ডিটেকশন ডিভাইস (বা HADD)। সে একটি হুমকি শনাক্ত করছে যার কোনো অস্তিত্ব নেই। এটি আমাদের যে-কারো ক্ষেত্রেই হতে পারে। উপরের ঘরের মেঝেতে হঠাৎ করে কোনো শব্দ হলে আমরা একজন আগন্তুক অনুপ্রবেশকারীকে কল্পনা করি। তারপর আমাদের মস্তিষ্কের যৌক্তিক অংশ সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং আমরা অনুধাবন করি যে, হঠাৎ দমকা হওয়া পুরনো মেঝের কাঠ খানিকটা নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। ডেইজি এভাবে যুক্তি ব্যবহার করতে পারে না। আর সে-কারণে নভেম্বর শুরু আর এর বারুদের ঋতু তার জন্যে আসলেই দুঃস্বপ্নের মতো। উচ্চগ্রামের কোনো শব্দ শুনলে তার প্রত্যুত্তরে তাকে পালাতে হবে–এভাবেই তার মস্তিষ্ক বিষয়টি পূর্বনির্ধারণ করে রেখেছে। আমার কাছ থেকে কোনো ধরনের ব্যাখ্যাই তাকে বোঝাতে পারবে না যে, আসলেই কেউ তার ক্ষতি করতে আসছে না।