সুতরাং প্রশ্ন কিন্তু ইতিহাসে অধিকাংশ সহিংসতার কারণ এটি ছিল কিনা তা নয়, বরং কেন তাহলে বিষয়টি নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত? আমরা যখন দাসপ্রথা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম, আমরা লক্ষ করেছিলাম, এমন কিছু পরিস্থিতি আছে যেখানে সহিংসতা একটি বৈধ নৈতিক বিকল্প। এটি হচ্ছে একটি মূলনীতি, যা প্রায় সব জাতিকে তাদের অভ্যন্তরীণ আর বাহ্যিক রাজনীতি পরিচালনা করতে দিকনির্দেশনা দেয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীর সবচেয়ে খ্রিস্টান জাতি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এবং এছাড়াও এটি পৃথিবীতে সবচেয়ে সহিংস একটি রাষ্ট্র। এটি মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছে এখনো। এটি সাধারণ নাগরিকদের নিজস্ব অস্ত্র রাখার অধিকার ও তাদের আত্মরক্ষার জন্যে সেগুলোর ব্যবহারে বিশ্বাস করে। এবং এর পরিণতিতে দেশটির বহু হাজার নাগরিক প্রতিবছরই নিহত হন আগ্নেয়াস্ত্রজনিত ঘটনায়। এছাড়াও অন্য বহু জাতির মতো, শক্র থেকে শুধুমাত্র নিজের সুরক্ষা করার মতো পরিস্থিতি ছাড়াও পৃথিবীর অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার সময়েও এটি সহিংসতার আশ্রয় নেয়। আমরা যদি এই পরিস্থিতিগুলোয় সহিংসতাকে যুক্তিযুক্ত করতে পারি, তাহলে আমরা কেন বিচলিত হই যখন ধর্ম তার নিজের উদ্দেশ্যপূরণে এটি ব্যবহার করে? আমরা খুবই হিংস্র একটি প্রজাতি। তাহলে ধর্মীয় সহিংসতা আমাদের কেন এত অস্বস্তিতে ভোগায়?
দুটি কারণ আছে। প্রথমত, যখন ধর্ম কোনো একটি দ্বন্দ্বে প্রবেশ করে এটি সেই মিশ্রণে একটি বিষাক্ত উপাদান যুক্ত করে, যা অন্য কোনো সংঘর্ষে সবসময় উপস্থিত থাকে না। এছাড়াও মানুষ সহিংসতা-প্রবণ এর প্রকৃতিতে, কিন্তু যদি তারা নিজেদের প্ররোচিত করতে পারেন, ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে তারা সেই কাজটি করছেন, তখন সেই সংঘর্ষে দয়া কিংবা সংযমের সব সুযোগই অপসারিত হয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে স্কটল্যান্ডে ধর্মীয় যুদ্ধবিগ্রহের সেই সময়টিতে, যা ‘দ্য কিলিং টাইম’ নামে পরিচিত, যুদ্ধের একটি স্লোগান ছিল, ‘গড অ্যান্ড নো কোয়ার্টার’, যার মানে কোনো দয়াপ্রদর্শন এবং বন্দি নেওয়া তাদের উচিত হবে না। এই সন্ধ্যার টিভি সংবাদে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিদ্বন্দ্বী মুসলমান গোষ্ঠীগুলো পরস্পরের উপর বোমাবর্ষণ দেখার সময়, আপনার এমন কিছু শুনতে পাবার সম্ভাবনা আছে, তারা যখন পরস্পরের বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছেন, তারা তখন। আল্লাহকে প্রশংসা করেই কিছু বলছেন।
আপনি যদি এই মহাবিশ্বের নৈতিক বিচারকের প্রতি অনুগত হয়ে কিছু করেন তাহলে আপনি অন্যায় কিছু করতে পারেন না। ঈশ্বর ছাড়া আর কিছু না’! আর সে-কারণেই ধর্মীয় উগ্রতাবাদীদের পারস্পরিক সংঘর্ষ বহু শতাব্দী ধরে অব্যাহত থাকতে পারে, যেখানে কোনো পক্ষই বিরোধ নিষ্পত্তি করতে আগ্রহ প্রকাশ করে না। আর যখন পুরনো দ্বন্দ্ব নতুন প্রাণশক্তিতে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে, এটিকে কখনো। কখনো ‘আইডেন্টিটি পলিটিক্স’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়। কোনো একটি অজনপ্রিয় গোষ্ঠী একটি উদ্দেশ্য আর আত্মপরিচয়ের ধারণা অর্জন করতে পারে একটি ধর্মবিশ্বাস বা ফেইথ ব্যবহার করে, যা এটিকে বাকি সবার থেকে পৃথক হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে। এটি বহিরাগতের সেই গৃহহীনতার অনুভূতি থেকে মুক্তি দিতে পারে। এটি তাকে ক্রোধে উন্মত্ত করে তুলতে পারে। এটি তাকে ২০০৫ সালে লন্ডনে জনাকীর্ণ পাতালরেলে আত্মঘাতী বিস্ফোরণের মাধ্যমে নিজেকে উড়িয়ে দেবার জন্য একটি কারণ দিতে পারে।
যদি ধর্মীয় সহিংসতার প্রথম কারণটি আমাদের বিতৃষ্ণ করে তুলে থাকে, সেটির কারণ হচ্ছে মানব-সংঘর্ষে এটি অযৌক্তিক একটি মাত্রার তীব্রতা যুক্ত করে, এর দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে একটি ভয়ংকর অসংগতি আছে এর কেন্দ্রে। এটি হচ্ছে সেই অসংগতি, বিশ্বাসীদের চেয়ে অবিশ্বাসীরা প্রায়শই অনেক বেশি স্পষ্টভাবেই সেটি দেখতে পারেন। আর এই অসংগতির নাম হচ্ছে ঈশ্বর। অধিকাংশ ধর্মই সেই দাবিটির ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত, ঈশ্বর হচ্ছে চূড়ান্ত বাস্তবতা। এবং তিনি তাদের নৈতিক আইনগুলোর রচয়িতা। বিষয়টির উপস্থাপনায় হয়তো তাদের মধ্যে পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু তারা সবাই ঈশ্বরকে একজন বিশ্বজনীন পিতা হিসাবে দেখেন। মানুষ হচ্ছে ঈশ্বরের সন্তান। যেমন, নিউ টেস্টামেন্ট বলেছে, ঈশ্বরের মধ্যে আমরা বাঁচি, চলাচল করি এবং আমাদের অস্তিত্ব লাভ করি।
কিন্তু যদি আমরা সবাই ঈশ্বরের সন্তান হয়ে থাকি, তাহলে কেন এই ঈশ্বর ইতিহাসের অধিকাংশ সময় জুড়ে তার বিশ্বজনীন পরিবারের একটি শাখাকে নির্দেশ দিচ্ছেন অন্য একটি শাখাকে বিলুপ্ত করতে? তার ইহুদি সন্তানদের প্রতি ভালোবাসাটিকে তার প্যালেস্টাইনীয় সন্তানদের নিশ্চিহ্ন করার মাধ্যমেই বা কেন প্রকাশিত হতে হবে? কেন তিনি পরে তার ইহুদি সন্তানদের পরিত্যাগ করেছিলেন। তার খ্রিস্টীয় সন্তানদের পক্ষ নিয়ে এবং তার নতুন প্রিয়ভাজনদের নির্দেশ দিয়েছিলেন তাদের বয়োজ্যষ্ঠ ভাইবোনদের নির্যাতন করতে? যারা তাকে এক এবং অদ্বিতীয় হিসাবে উপাসনা করেন, তার সেই মুসলমান সন্তানদের কেন তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, তার বহুঈশ্বরবাদী সন্তানদের নির্যাতন করতে, যারা কিনা তাকে উপাসনা করে বহুসংখ্যক রূপে? ধর্মীয় ইতিহাসে এত সহিংসতা কেন, যা ঘটিয়েছে। সেই গোষ্ঠীগুলো, যারা ঈশ্বরকে তাদের পক্ষে আছেন বলে দাবি করেছেন?