আমরা যদি আমাদের এই আলোচনাটি তিনটি আব্রাহামিক ধর্ম, ইহুদিবাদ, খ্রিস্টধর্ম আর ইসলামের মধ্যে সীমিত রাখি, এই অভিযোগটি বৈধ অনুভূত হয়। ইহুদি ধর্মের আদি ইতিহাসে প্রচুর সহিংসতা আছে। এটি ছাড়া মিশরে দাসত্ব থেকে ইহুদিদের মুক্তি অর্জন করা সম্ভব হতো না। আর সেই কারণে, এই সহিংসতা আবশ্যিক ছিল কিনা সেই প্রশ্নটি করতে আমাদের এখানে একটু বিরতি নেওয়া উচিত। অন্যদের বিরুদ্ধে সহিংসতা কখনোই যুক্তিযুক্ত হতে পারে না, এমন কিছু ইতিহাসে খুব অল্প কয়েকজনই দাবি করেছেন। অবশ্যই সবসময়ের জন্য অশুভ একটি কাজ, কিন্তু মাঝে মাঝে এটি দুটি অশুভ কাজের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম অশুভ একটি কাজ হতে পারে। দাসপ্রথা অবশ্যই অশুভ। এটি মানুষকে মানুষ নয় বরং পশু হিসাবে বিবেচনা করে, মনিবদের খেয়াল-খুশিমতো যাদেরকে দিয়ে যে-কোনো কিছু করিয়ে নেওয়া যায় এবং মনিবের খেয়ালমতো প্রয়োজনে বাতিল করাও যায়। বর্তমান সময়ের অধিকাংশ মানুষই দাসদের অধিকার এবং মনিবদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং স্বাধীনতার জন্যে তাদের যুদ্ধ করার অধিকারকে সমর্থন করবেন। আর ইহুদিরা সেটাই করেছিলেন। তারা তাদের মনিবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন, এবং মরুভূমিতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এর পরে যা ঘটেছিল সেখানেই সবকিছু আরো জটিল হয়ে উঠেছিল।
খ্রিস্টের জন্মের ১৩০০ বছর আগে ইজরায়েলাইটরা সেই সময়ের কানানে (এখন প্যালেস্টাইন) যে-গোত্রগুলো বসবাস করত, তাদের সাথে যা কিছু করেছিল –তারা বিশ্বাস করতেন এই গোত্রগুলো ঈশ্বরের বিরুদ্ধে পাপ করেছিল –ঊনবিংশ শতকে আদিবাসী আমেরিকানদের সাথে খ্রিস্টান বসতিস্থাপনকারীরা সেই একই কাজ করেছিলেন। পুরো একটি মানবগোষ্ঠীকে বাস্তুচ্যুত আর ধ্বংস করার এই প্রক্রিয়াটি বর্ণনা করতে ব্যবহৃত আধুনিক শব্দটি হচ্ছে, ‘জেনোসাইড’ বা গণহত্যা। আর এই ঘটনাগুলোকে আসলে গণহত্যা বলাই সঠিক হবে। আর এই গণহত্যার দায়ভার অবশ্যই বাইবেলের ওপরেই দিতে হবে। ইতিহাসবিদরা হয়তো প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের বসতি গড়তে কতটা সময় লেগেছিল, এবং আসলেই সেটি কতটা সহিংস ছিল এসব বিষয় নিয়ে বিতর্ক করতে পারেন। তবে যে-হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছিল সে-বিষয়ে বাইবেল খুবই সুস্পষ্ট এবং এটি বলেছে ঈশ্বরের নির্দেশে সেই গণহত্যাগুলো ঘটেছিল। আর যে-বইটিতে এর বিস্তারিত বর্ণনা আছে সেটির নাম জশুয়া। এই বইয়ে প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সেই বাক্যগুলো, যেমন, ‘তোমরা তাদের পুরোপুরিভাবে ধ্বংস করবে’ এবং ‘তারা তাদের ধ্বংস করেছিল’ এবং ‘তারা এমন কিছু বাকি রাখেনি যা শ্বাস নেয়’। জশুয়া আমাদের বলছে, তাদের জন্যে প্রতিশ্রুত ভূমিতে ইজরায়েলের গোত্রগুলোর বসতিস্থাপন করা সম্ভব হয়েছিল সহিংসতার মাধ্যমে, যার নির্দেশনা দিয়েছিলেন স্বয়ং ঈশ্বর।
যখন আমরা খ্রিস্টধর্ম নিয়ে আলোচনা করব আমরা দেখব, এই ধর্মটিরও সহিংস একটি সূচনা ছিল, কিন্তু এটি সহিংসতার শিকার ছিল, সহিংসতাকারী ছিল না। শুরুর বছরগুলোয় এই ধর্মটি পার্থিব রাজনীতিতে নিজেকে যুক্ত করার মতো যথেষ্ট পরিমাণ দীর্ঘ সময় টিকে থাকতে পারবে, এমন কোনো প্রত্যাশা করেনি। এমন নয় যে, এই অবস্থান নির্যাতন থেকে তাদের রক্ষা করতে পেরেছিল। এটি ক্রুশবিদ্ধ এক ঈশ্বরকে উপাসনা করেছিল এবং এর নিজের দুঃখগুলোকে এটি গ্রহণ করে নিয়েছিল। আর এর পরিসমাপ্তি ঘটেছিল যখন সম্রাট কনস্টান্টিন এই ধর্মটি তার ধর্ম হিসাবে গ্রহণ এবং তার স্বার্থে এটি ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন। এরপর থেকেই চার্চ সহিংসতার একটি স্বাদ অনুভব করতে শুরু করেছিল এবং কীভাবে নিয়ন্ত্রণের একটি উপকরণ হিসাবে এটিকে ব্যবহার করা যায় সেটি শিখেছিল। বহু শতাব্দী ধরে ইহুদিদের বিরুদ্ধে এটি সহিংসতা ব্যবহার করেছে, যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করার জন্যে ‘ঈশ্বর হত্যাকারী’ হিসাবে তারা তাদের চিহ্নিত করেছিল, এবং এই প্রক্রিয়ায় তারা যিশুর সারমন অন দ্য মাউন্টে বক্তৃতা দেবার সময় কী বলেছিলেন সেটি ভুলে গিয়েছিল। ক্রুসেডগুলোর সময় এটি মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রয়োগ করেছিল। ইনকুইজিশন পর্বে এটি ভিন্নমতাবলম্বী অন্য খিস্টানদের হত্যা করেছিল। আর রিফরমেশন আন্দোলন পরবর্তী ধর্মীয় যুদ্ধগুলোয় প্রতিদ্বন্দ্বী খ্রিস্টান গোষ্ঠীগুলো পরস্পরের সাথে যুদ্ধ করেছিল যতদিন-না সমাজ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল তাদের পারস্পরিক রক্তপিপাসায় এবং এটি বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছিল।
ইসলামের জন্মেও সহিংসতা আছে। যদিও ‘জিহাদ’ বা সংগ্রামের ধারণাটিকে অহিংস উপায়ে বোঝা সম্ভব হতে পারে, এছাড়াও এটিকে ইনফিডেল বা অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে ঘটানো সহিংসতাকে যুক্তিযুক্ত করতে ব্যবহার করা হয়েছে। খিস্টানদের মতোই, মুসলমানরা স্বধর্মী বিশ্বাসীদের হত্যা করতে সক্রিয় ছিল, যারা এই ধর্মবিশ্বাসটির একটি ভিন্ন সংস্করণের অনুসারী ছিলেন। খ্রিস্টধর্মে ক্যাথলিক আর প্রটেস্টান্টরা যেমন করেছিলেন, শিয়া আর সুন্নীরা পরস্পরকে হত্যা করেছে সেই একই রকম উৎসাহ নিয়ে। এবং তাদের পারস্পরিক ঘৃণা আজও মধ্যপ্রাচ্যে সংঘর্ষের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে একটি।