ক্ষমতার ব্যাপারে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়, আর এখানেই আলোচনায় ধর্মের প্রবেশ ঘটবে। ক্ষমতাবানরা নিজেদের স্বার্থেই ক্ষমতা ভালোবাসেন কিন্তু তারা তাদের সেই লালসাটিকে নানা তত্ত্ব দিয়ে ঢেকে রাখেন, যে-তত্ত্বগুলো এটির সত্যতা প্রতিপাদন করে। নারীদের ভোটের অধিকার না-দেবার জন্যে তারা যে তত্ত্বটি ব্যবহার করেছিলেন, সেটি হচ্ছে নারীদের মস্তিষ্ক রাজনীতির জটিলতা বোঝার মতো ক্ষমতা রাখে না। রাজনীতি শুধুমাত্র পুরুষদের জন্যে। আর নারীদের কাজ সন্তান জন্ম দেয়া। আর মানুষকে তাদের অবস্থানে বন্দি করে রাখার কারণগুলোর সবচেয়ে সেরা জোগানদাতা সবসময়ই ছিল ধর্ম। আমরা এটিকে কাজ করতে দেখেছি দাসপ্রথা বিলোপ নিয়ে তর্কের সময়। বাইবেল আর কুর’আন দুটি ধর্মগ্রন্থই দাসপ্রথাকে স্বাভাবিক মেনে নিয়েছে। নারীদের অবস্থানে অধস্ত নতাও তারা খুব স্বাভাবিক হিসাবে সমর্থন দিয়েছে। সুতরাং আমরা সেই অস্বস্তি কর বাস্তব তথ্যের মুখোমুখি হই, পবিত্র এই ধর্মগ্রন্থগুলোকে সেই মানুষগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রের জোগান দিতে ব্যবহার করা যেতে পারে, যারা অন্যদের তাদের নিয়ন্ত্রণে আটকে রাখতে চান।
এবং এখনো এই বইগুলোকে একইভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। মৌলবাদী খ্রিস্টানদের জন্যে পুরুষদের নিয়ন্ত্রণ থেকে নারীদের মুক্তি একটি বিশালমাত্রার সমস্যা, কারণ বাইবেল বলেছে নারীদের পুরুষদের অধস্তন থাকা উচিত এবং তাদের ওপর নারীরা কখনোই কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারবেন না। আজও বেশিরভাগ খ্রিস্টীয় জগৎ এখনো নারীদের চার্চে আনুষ্ঠানিকভাবে যাজক হবার প্রবেশাধিকারটিকে রুদ্ধ করে রেখেছে। এই বিষয়টি এমনকি ক্যাথলিক চার্চে আলোচনার কথা ভাবাই হয় না, যে-কোনো মাত্রায় এই গ্রহে যারা সবচেয়ে বৃহত্তম একটি সংগঠন, যাদের সদস্যসংখ্যা হাজার কোটির উপরে। এমনকি খ্রিস্টধর্মের অপেক্ষাকৃত উদারনৈতিক শাখাগুলোও বহুযুগ ধরে এই প্রশ্নটি নিয়ে বিতর্ক করেছে। কেবলমাত্র ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে চার্চ অব ইংল্যান্ড নারীদের জন্য বিশপ হবার পথ উন্মুক্ত করেছিল। ঠিক যেভাবে তারা ডারউইনের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে, আর প্রক্রিয়াটি যতই কষ্টকর অনুভূত হোক না কেন, নারী স্বাধীনতা আর অধিকারের প্রশ্নে উদারনৈতিক ধর্মগুলো খাপ খাইয়ে নিতে শিখেছে। কিন্তু সময় একই জায়গায় স্থির হয়ে থাকে না, আর তাদের এখন এমনকি আরো কষ্টকরভাবে সমকামীদের মুক্তির প্রশ্নটিরও মুখোমুখি হতে হবে।
খ্রিস্টধর্মের জন্যে এই পরিবর্তনগুলো বেশ যথেষ্ট পরিমাণ কঠিন প্রমাণিত হয়েছিল বেশকিছু কারণে, ইসলামের জন্যে এটি এমনকি আরো বেশি কঠিন। আর এখানে পরিবর্তনের সাথে সমঝোতা করার বিষয়টি আরো বেশি সহিংসতায়। পরিণত হয়েছিল। মৌলবাদী মুসলমানরা শুধুমাত্র ক্রুদ্ধ নয় : তাদের সবচেয়ে চরম রূপে তারা নৃশংসভাবে মানব-হত্যাকারীও। ইসলামের এই সমস্যার নেপথ্যে আছে বেশকিছু নিয়ামক, যাদের অনেকগুলোই এই বইয়ের বিষয়বস্তুর আওতার বাইরে। কিন্তু অন্যসব ধর্মীয় মৌলবাদীদের সাথে তারাও একটি সাধারণ সমস্যা ভাগ করে নিয়েছে। এমনকি ইজরায়েলের মৌলবাদী ইহুদিদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য। ইজরায়েলে মৌলবাদী ইহুদিরা তাদের তথাকথিত পবিত্রভূমি প্যালেস্টাইনিদের সাথে ভাগ করে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তাদের যুক্তি হচ্ছে ঈশ্বর বহু হাজার বছর আগেই প্যালেস্টাইনকে তাদের বসবাসের জন্য দান করেছিলেন, আর তারা শুধু সেটি নিজেদের দখলে নিচ্ছেন, যা তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। আপনি যদি তাদের এই অবস্থানের কারণ সৃষ্ট বিপদগুলোর কথা তাদের স্মরণ করিয়ে দেন তাহলে তারা সেই বাক্যটির পুনরাবৃত্তি করবে, খ্রিস্টীয় মৌলবাদীরা, যা ডারউইনকে বলেছিলেন। আমরা ঠিক বলছি, এবং আপনি ভুল, কারণ বাইবেল আমাদের সেটি বলছে।
আর যেহেতু বাইবেল আর কুর’আন এভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, মনে হতে পারে এই বইগুলোই সমস্যা, এইসব সংঘর্ষগুলোর প্রাদুর্ভাবের কারণ। অথবা, অন্যভাবে যদি বলি : এই বইগুলোর আধেয় ঈশ্বরের কাছ থেকে আশা ঐশী প্রত্যাদেশ, এই ধারণাটি মূলত সমস্যা। আর যাই হোক না কেন, আমি আপনার সাথে নারী অথবা সমকামীদের অবস্থান ও অধিকার বিষয়ে তর্ক করতে পারি, এবং আমরা একমত বা ভিন্নমত পোষণ করতে পারি। কিন্তু যখনই আপনি আমাকে বলবেন এই বিষয়গুলোর ব্যাপারে আপনার দৃষ্টিকোণ আপনার নিজের না বরং ঈশ্বরের, তখন বির্তক অসম্ভব হয়ে যায়। এটি আবার সেই মাঙ্কি ট্রায়ালের পুনরাবৃত্তিতে পরিণত হয়।
মৌলবাদীরা বিতর্ক করেন না, তারা কোনো প্রমাণ দেবার চেষ্টা করেন না। তারা একটি রায় ঘোষণা করেন। রায়টি সবসময়ই হবে ‘দোষী’, কারণ তাদের পবিত্র বই এই বিষয়টি ইতিমধ্যেই নির্ধারণ করেছে। এর মানে আমাদের সময়ে এর সহিংস সংস্করণগুলোসহ মৌলবাদের সমস্যা একটি প্রশ্ন উপস্থাপন করে, যার শিকড় ধর্মের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত, যা দাবি করে এর ভিত্তির মূলে আছে। সরাসরি ঈশ্বরপ্রেরিত প্রত্যাদেশগুলো। যদি শুধুমাত্র অজ্ঞতার প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনই নয় বরং সহিংসতার প্রতি তাদের ভালোবাসাকে যুক্তিযুক্ত করে এটি ব্যবহৃত হয়, নিশ্চয়ই তাহলে মৌলিকভাবেই এই অবস্থানে একটি বড় ভ্রান্তি আছে, অর্থাৎ তারা ভুল করছেন, যদি তাদের নিজেদের শব্দ ঋণ করে বলি। তাহলে ধর্ম কীভাবে এই সুনির্দিষ্ট সমস্যা থেকে উত্তরণের কথা ভাববে? আর সেই প্রশ্নটির উত্তর বিবেচনা করব পরের অধ্যায়ে, যখন আমরা ধর্মের সহিংস ইতিহাসটি আরো নিকট থেকে দেখব।
৩৯. পবিত্র যুদ্ধগুলো
মানব-ইতিহাসে সহিংসতাগুলোর প্রধান কারণ কি ধর্ম, যেমন অনেকেই প্রস্তাব করেছেন? অবশ্যই ধর্মে সহিংসতা অপরিচিত কোনো বিষয় নয়। অতীতে এটি সহিংসতাকে ব্যবহার করেছিল, আজও এটি সহিংসতাকে ব্যবহার করছে। কিন্তু এটি কি সহিংসতার কারণ’? বহু চিন্তাশীল মানুষ এমনটাই মনে করেন। কেউ কেউ এমনকি আরো প্রস্তাব করেন, পৃথিবী থেকে সহিংসতা নির্মূলের উপায় হচ্ছে ধর্মকে নির্মল করা। কেউ আবার এই যুক্তিটিকে আরো কিছুটা অগ্রসর করেছেন এমন কিছু বলে, যেহেতু ঈশ্বর নিজেই সহিংসতার নির্দেশ দিয়েছেন, যা মানবতার ওপর খুব বড় একটি অভিশাপ, আর মানবতাকে এই অভিশাপ থেকে রক্ষা করার শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে ঈশ্বরকেই বাতিল করা। খুব শক্তিশালী একটি অভিযোগ, এবং যে-অভিযোগটি আমরা উপেক্ষা করতে পারি না।