এর বিরুদ্ধে প্রথম প্রচণ্ড আক্রমণটি সূচনা করেছিল একটি ধারাবাহিক পুস্তি কা, যা প্রকাশ করেছিল একটি গোষ্ঠী, যারা নিজেদের নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য ওয়ার্ল্ডস ক্রিশ্চিয়ান ফান্ডামেন্টালস অ্যাসোসিয়েশন’। ফান্ডামেন্টাল হচ্ছে শক্তিশালী ভিত্তি। এমন ভিত্তির ওপর যদি আপনি কোনো বাড়ি নির্মাণ করেন তাহলে সময়ের প্লাবন সেটি ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। এই পুস্তিকার লেখকদের মতে, যে ভিত্তির ওপর খ্রিস্টধর্ম প্রতিষ্ঠিত এবং নির্মিত হয়েছে, সেটি বাইবেলের অভ্রান্ত সত্য। এর প্রতিটি শব্দ স্বয়ং ঈশ্বর উচ্চারণ করেছেন, আর ঈশ্বর কখনোই ভুল করতে পারেন না। বাইবেলে যা আছে তা সবই চূড়ান্ত সত্য, ঈশ্বরের নিজের শব্দ। আর মানুষের কোনো শব্দ, যা এর সাথে ভিন্নমত প্রদর্শন করে, সেটি অবশ্যই ভুল। ডারউইন এর বিরোধিতা করেছিলেন। সে-কারণে ডারউইন ভুল!
মৌলবাদীরা বিজ্ঞানকে ভ্রান্ত প্রমাণ করার কোনো চেষ্টা করেননি। তারা এর বিরুদ্ধ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে কোনো বিতর্ক করেননি। এর বিরুদ্ধে তারা তাদের অভিমত ‘ঘোষণা’ করেছিলেন। এটি কোনো শিশুর সাথে বিতর্কের সময়ে পিতামাতারা যখন বিতর্কটি জিততে গিয়ে চিৎকার করে বলে থাকেন : ‘এটি ঠিক কারণ আমি বলছি’, এটি তার সমতুল্য ছিল। আর মৌলবাদী ধর্ম এটাই করে থাকে। এটি কোনো প্রমাণ দিয়ে যুক্তি খণ্ডন করে না বরং তর্কে জিততে এটি ‘কর্তৃত্বের’ সহায়তা নেয়। ডারউইন কেন ভুল? কারণ, বাইবেল সেটাই বলছে। কিন্তু বাইবেলের কর্তৃত্বকে অভ্রান্ত হিসাবে দাবি করা ছাড়াও তারা আরো কিছু করেছিল। তারা বিজ্ঞানকেই নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল। আর তখন সেটি প্রতিরোধ করতে বিজ্ঞান পাল্টা যুদ্ধ শুরু করেছিল।
খ্রিস্টান চার্চ নেতা আর যাজকদের ক্ষুব্ধ প্রতিবাদে প্ররোচিত হয়ে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি রাজ্য এর সব স্কুলে বিবর্তন বিষয়ে শিক্ষাদান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। বাইবেলে বর্ণিত স্বর্গীয়ভাবে মানব সৃষ্টি হবার কাহিনিটি অস্বীকার করে, এর পরিবর্তে মানুষ নীচুশ্রেণির কোনো প্রাণীদের থেকে উদ্ভব হয়েছে এমন দাবি করা কোনো তত্ত্ব শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদান করা টেনেসি রাজ্যে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধে পরিণত হয়েছিল। একজন তরুণ শিক্ষক জন থমাস স্কোপস এই নতুন আইনটিকে চ্যালেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি তার শিক্ষার্থীদের বিবর্তন বিষয়ে পড়িয়ে আইন ভঙ্গ করার অপরাধে কারাগারে বন্দি হয়েছিলেন। তার পরিকল্পনা ছিল আদালতের এই বিচারপ্রক্রিয়াটি ব্যবহার করে প্রদর্শন করা যে, জেনেসিস থেকে উদ্ধৃতি ব্যবহার করে বিবর্তনকে অপ্রমাণ করার প্রচেষ্টা কতটা বোকামি হতে পারে। আমেরিকার সিভিল লিবার্টিস ইউনিয়নের সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্রের সেই সময়ে সবচেয়ে বিখ্যাত আইনজীবী ক্লারেন্স ড্যারো তার পক্ষে আদালতে কেসটি লড়েছিলেন। স্কোপসের এই কেসটি ‘দ্য মাঙ্কি ট্রায়াল’ নামে পরিচিত পেয়েছিল কারণ, ডারউইন দাবি করেছিলেন নরবানরের বংশধারায় মানুষরা বিবর্তিত হয়েছে। স্কোপস বিবর্তন পড়িয়েছেন বলে তার দোষ স্বীকার করেন, এবং তাকে ১০০ ডলার জরিমানা করা হয়েছিল। ড্যারো এই আইনি লড়াই ব্যবহার করেছিলেন মৌলবাদীদের অবস্থানের স্ববিরোধিতাগুলো প্রদর্শন। করতে এবং প্রমাণ করতে যে, এর প্রধান মুখপাত্ররা নিজেরাই জানেন না যে, তারা কী বিষয়ে কথা বলছেন। স্কোপস কেসটি হেরেছিলেন ঠিকই কিন্তু ড্যারো তার তর্কে জিতেছিলেন। তবে ১৯৬৮ অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্ট শ্রেণিকক্ষে বিবর্তন পড়ানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা এই আইনটি বাতিল করেছিল।
স্কোপের এই আইনি লড়াইটি দেখিয়েছিল যে, কীভাবে নতুন জ্ঞান মৌলবাদীদের ক্রোধ জাগিয়ে তুলতে পারে। যে-কোনো বর্ণনার মৌলবাদীরা ইতিহাস আর এর বহন করে আনা পরিবর্তনগুলো পছন্দ করেন না। তারা বরং টেনিস কোর্টে তাদের র্যাকেট আছড়ে ভাঙবেন, কিন্তু ভবিষ্যৎ থেকে তাদের কাছে যা আসছে, তা মেনে নেবেন না। অতীত তাদের একমাত্র কাম্য। তারা চিৎকার করে বলেন, কেন আপনারা বারবার ভবিষ্যতের কথা তুলছেন?’ মৌলবাদ হচ্ছে বদমেজাজের একটি ঘোর, এটি সেই উন্মত্ত ক্রোধ, নতুন বাস্তবতা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি।
কিন্তু যদি বৈজ্ঞানিক পরিবর্তন আর নতুন জ্ঞান, যা এটি বহন করে আনে, সেটি যদি মৌলবাদী মনের পক্ষে গ্রহণ করে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে, তাহলে আমরা যেভাবে সমাজ পরিচালনা করছি সেখানে কোনো পরিবর্তন মেনে নেওয়া তাদের জন্যে এমনকি আরো বেশি কঠিন প্রমাণিত হয়। আমাদের এই সময়ে, ধর্মীয় মৌলবাদ বিজ্ঞানের চাপের চেয়ে বরং সামাজিক পরিবর্তনের কারণে আরো অনেক বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এবং কিছু ক্ষেত্রে এটি শুধুমাত্র ক্রুদ্ধই হয় না, সহিংস হয়ে ওঠে।
বিংশ আর একবিংশ শতাব্দীতে সবচেয়ে বেশি বৈপ্লবিক যে-পরিবর্তনটি পৃথিবীকে ধাক্কা দিয়েছিল, সেটি ছিল নারীদের মুক্তি। বাইবেল এবং কুর’আন এসেছিল এমন সমাজ থেকে, যা পুরুষদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। এখানে বিস্মিত হবার কোনো কারণই নেই। বেশ সাম্প্রতিক সময় অবধি পৃথিবীর সর্বত্র এভাবেই চলছিল। আর এই প্রসঙ্গটির গভীরে প্রবেশ করার আগে একটি বিষয় লক্ষণীয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, ক্ষমতায় থাকায় পুরুষরা কখনোই স্বেচ্ছায় তাদের সুবিধাগুলো ছেড়ে দেননি। একদিন তারা ঘুম থেকে উঠে এমন কিছু বলেননি যে, ‘আমি হঠাৎ করে অনুভব করলাম, যেভাবে আমি অন্যদের নিয়ন্ত্রিত আর প্রভাবিত করি সেটি ভুল। আমাকে অবশ্যই আমার আচরণ পরিবর্তন করতে হবে। সুতরাং আমি তাদের সাথে আমার ক্ষমতা ভাগ করে নেব। আমি তাদের ভোটের অধিকার দেব’! কখনোই পরিবর্তন আসলে এভাবে ঘটেনি। ইতিহাস দেখিয়েছে ক্ষমতা যাদের কাছে আছে, তাদের কাছ থেকে আসলেই ক্ষমতা জোর করে আদায় করে নিতে হয়। সাফরাজেটসরা, যারা নারীদের সাফরেজ বা ভোটাধিকারের জন্যে লড়াই করেছিলেন, তারা সেই শিক্ষাটি পেয়েছিলেন। পুরুষরা স্বেচ্ছায় নারীদের ভোটাধিকার দেয়নি। নারীদের সেটি আদায় করে নিতে যুদ্ধ করতে হয়েছিল।