তার নাম ছিল চার্লস ডারউইন। তার গবেষণায় ডারউইন উপসংহারে পৌঁছেছিলেন, আমাদের এই গ্রহে সব প্রজাতি খুবই দীর্ঘ সময় ধরে বিবর্তিত হয়েছে তাদের পরিবেশের সাথে ক্ষুদ্র অভিযোজনগুলো পুঞ্জিভূত হবার একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। ছয় দিনের সেই সৃষ্টিতত্ত্ববাদের ধারণাটি ধসে পড়েছিল। ধর্মীয় খ্রিস্টানদের জন্যে এটাই যথেষ্ট পরিমাণ একটি বিপর্যয় ছিল, কিন্তু আরো বড় বিপর্যয়টি ছিল তার সেই দাবিটি, ছয় হাজার বছর আগে একদিন বিশেষভাবে সৃষ্টি হবার মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে গঠিত মানুষ আবির্ভূত হয়নি। তারাও বহু মিলিয়ন বছর ধরে ধীরে ক্রমান্বয়ে বিবর্তিত হয়েছিল। এবং নরবানর বা এইপরা ছিল তাদের। সবচেয়ে সাম্প্রতিকতম পূর্বসূরি! যখন ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ডারউইনের ‘অন দ্য অরিজিন অব স্পিসিস’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল, এটি সেইসব মানুষগুলোর জন্যে বেশ বড় একটি সংকটের সৃষ্টি করেছিল, যারা ঈশ্বরের মহাবিশ্ব সৃষ্টি করার প্রশস্তিতে লেখা একটি কবিতা হিসাবে বাইবেলের গল্প না-পড়ে সেটিকে আসলেই তিনি কীভাবে এই কাজটি করেছিলেন তার একটি বিস্তারিত নিখুঁত বিবরণ হিসাবে পড়তেন। ডারউইনের এই বইটির প্রতি খ্রিস্টানরা বিভিন্ন উপায়ে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন।
অনেকেই বইটি পড়েছিলেন এবং বিশ্বাস করতে পেরেছিলেন যে, ডারউইন সঠিক কথাই বলছেন। সুতরাং অবশ্যই বাইবেল ভুল। এবং তাদের ধর্মবিশ্বাসে ধস নেমেছিল। আর ধর্মকে এভাবে হারিয়ে ফেলা তাদের জন্যে সুখকর কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না, অনেকটা সেই অনুভূতির মতো, যা শিশুরা অনুভব করে, যখন তারা সান্টা ক্লস বিশ্বাস করা থামিয়ে দেয়। কিন্তু অন্য বিশ্বাসীরা ডারউইনের বই থেকে একটি পাতা বাতিল করে, তাদের ধর্মকে নতুন বিজ্ঞানের সাথে সংগতিপূর্ণ করে তুলেছিল। নতুনভাবে বাইবেল পড়া শেখার মাধ্যমে তারা এটি করেছিলেন। বাইবেল হচ্ছে শিল্পকলা, বিজ্ঞান নয়। এটি এমনভাবে পরিকল্পিত যে, এটি আপনাকে জীবনের অর্থ নিয়ে ভাবতে বাধ্য করবে, কিন্তু জীবনের যন্ত্র কোন্ প্রক্রিয়ায় চলছে সেই বিষয়ে কোনো তথ্য দেবে না।
তাদের ধর্ম টিকে গিয়েছিল। তবে এটি এর আগের সেই নিশ্চয়তাটি হারিয়েছিল। এর মানে প্রথমবারের মতো এটি একটি ‘ফেইথ’ বা বিশ্বাসে পরিণত হয়েছিল। নিশ্চয়তা কোনো ‘বিশ্বাস’ নয়। এটি বিশ্বাসের বিপরীত। আপনি যদি কোনোকিছুর ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে থাকেন, তাহলে সেটি বিশ্বাস করার কোনো প্রয়োজন নেই আপনার। আপনি সেটি জানবেন। আমি যেমন ২+২=৪ এটি বিশ্বাস করি না, আমি এটি ‘জানি’। আমি এই বিষয়ে নিশ্চিত। আমি আমার হাতেই গণনা করে এটি দেখাতে পারব। কিন্তু আমি নিশ্চিত হতে পারব না যে, জীবনের একটি সামগ্রিক অর্থ আছে এবং এই বিশ্বের একজন স্রষ্টা আছেন, যিনি এটিকে ভালোবাসেন। অথবা এই জীবনে মৃত্যু হলে আমরা আরেকটি জীবনে প্রবেশ করব। এসবের কোনোটাই নিশ্চিতভাবে জানা যাবে না। আমরা হয় এটি বিশ্বাস করব, নয়তো করব না, অর্থাৎ ফেইথ আছে অথবা নেই। আর এর নিজেকে আরো ভালোভাবে বুঝতে এবং যেভাবে এটি নিজের সম্বন্ধে কথা বলে সেটি পরিবর্তন করতে সহায়তা করে আধুনিক বিজ্ঞান ধর্মের উপকার করেছিল।
কিন্তু কিছু খ্রিস্টান আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে কোনো সমঝোতায় আসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তারা যেমন তাদের বিশ্বাস কখনো আত্মসমর্পণ করবেন।, একইভাবে তারা এর কারণে তাদের বিশ্বাসকে ভিন্নভাবে বোঝার কোনো উপায় খুঁজতেও অস্বীকার করেছিল। তারা এর বিরুদ্ধে লড়তে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বিজ্ঞান তাদের যেমন বিষণ্ণ করেনি, তেমনি এটি তাদের চিন্তা করতেও প্ররোচিত করতে পারেনি। এটি তাদের ক্রুদ্ধ করে তুলেছিল। আর মৌলবাদে মূল উপকরণে পরিণত হয়েছিল এই ক্রোধ। এটি বুঝতে আপনাকে সেই হতাশা আর ক্রোধটি অনুভব করতে হবে, যা এটিকে উসকে দিয়েছে।
বিকল হয়ে যাওয়া কোনো যন্ত্রের ওপর কি আপনি কখনো আপনার মেজাজ হারিয়েছেন, চেয়েছেন এটিকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে ঘরের অন্যদিকে? আপনি কি কখনো কোনো টেনিস-খেলোয়াড়কে দেখেছেন রাগে মাটির উপর তাদের র্যাকেট আছড়ে ফেলতে, যেন এই মাত্র যে-শটটি তিনি খেলতে ব্যর্থ হয়েছেন তার জন্যে দায়ী হচ্ছে সেই র্যাকেটটি? জীবন নিরন্তরভাবেই আমাদের দিকে নানা পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়, আমাদের যা স্বস্তির বলয় থেকে ধাক্কা দিয়ে বাইরে বের করে দেয়। আর কিছু মানুষ এই পরিবর্তনগুলো সামাল দেবার ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি দক্ষ। কেউ কেউ জীবনে নতুন চ্যালেঞ্জগুলোর সাথে সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। আমরা তাদের বলি আর্লি অ্যাডপটার’। যেমন, নতুন আইফোন বা আইপ্যাড হাতে নেবার জন্যে তারা খুবই অস্থির হয়ে থাকেন। অন্যরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও খাপ খাইয়ে নিতে বাধ্য হন। আর কেউ কেউ খাপ খাইয়ে নিতে অস্বীকার করেন। তারা পরিবর্তন ঘৃণা করেন এবং এর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়েই লড়াই করেন। বিশেষ করে যদি এটি তাদের বহুদিনের লালিত কোনো বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করে। আধুনিক যুগে পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে বিজ্ঞান, সুতরাং এটি বহু ক্রুদ্ধ বিশ্বাসীর ক্ষোভের নিশানায় পরিণত হয়েছিল, যারা অনুভব করেছিলেন এটি অতর্কিতে তাদের আক্রমণ করেছে। ১৯১০ থেকে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের মধবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের ক্রোধ তীব্রতর হয়ে উঠেছিল। আর ডারউইনের বিবর্তনের প্রস্তাবনাটি এই যুদ্ধটি শুরু করেছিল।