বাহা’ই অনুসারীরা বিশ্বাস করেন যে, পৃথিবীর সব ধর্মই ঈশ্বর রহস্যটির কিছু-না-কিছু অংশ বুঝতে পেরেছে, সুতরাং সব ধর্মকেই শ্রদ্ধা করা উচিত। ঈশ্বরের মনের যে ক্ষণিক দৃশ্যগুলো তারা দেখেছেন সেগুলো সবই সত্য। কিন্তু কেউই সম্পূর্ণ চিত্রটি দেখতে পারেননি। এমনকি তাদের নবী বাহা’ইও সেটি পারেননি। বাহা’ই শুধুমাত্র এর একটি সাম্প্রতিকতম সংস্করণ। এবং এর সরলতার সৌন্দর্য আছে। এটি স্বীকার করে যে, পৃথিবীতে বহু ধর্ম আছে, কিন্তু সেগুলো সবই একই ঈশ্বরের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই অর্থে প্রতিটি ধর্মই আসলে ইতিমধ্যেই একই ধর্ম। আর তাদের পৃথক দৃষ্টিকোণ নয়, ধর্মগুলো যার’ দিকে তাকিয়ে আছে সেটিই তাদের একীভূত করেছে। ধর্মগুলো এটি ভুলে যায়।
কী দেখা হচ্ছে আর যিনি এই দেখার কাজটি করছেন, এ দুটি বিষয় নিয়ে তারা। সংশয়গ্রস্ত হয়ে পড়েন। অন্ধ মানুষ আর হাতির সেই নীতিগল্পটি এখানে আমরা আবার স্মরণ করতে পারি, যদি খানিকটা ভিন্নভাবে চিন্তা করা হয়। হাতি একটি, তবে প্রত্যেকেই পরস্পর থেকে পৃথক একটি দৃষ্টিকোণ থেকে সেটি দেখছেন।
তাহলে বাহা’ইদের দৃষ্টিকোণ কোন্টি? ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয় এই প্রস্তাবনার মধ্যে নতুন কিছু নেই। বাহা’ইরা যে-বিষয়টির দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন সেটি হচ্ছে, সমগ্র মানবতাও এক ও অভিন্ন। মানবজাতির এই সমগ্রতার শিক্ষাটি, ঈশ্বরের সমগ্রতা শিক্ষার মতো একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এবং এর বেশকিছু প্রত্যক্ষ প্রায়োগিক নিহিত্যার্থ আছে। যে ধর্মগুলো মনে করে যে, তারাই ঈশ্বরের শেষ কথা, তাদের একটি ট্র্যাজেডি হচ্ছে তারা পরস্পর দ্বন্দ্বরত প্রতিপক্ষ রূপ বহু গোত্রে সমগ্র মানবতাকে বিভাজিত করে। তখন ধর্ম মানবতার সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হয়। কিন্তু একবার যখন এটি অনুধাবন করতে পারে, যদিও সব ধর্মগুলো পরস্পর থেকে পৃথক দৃষ্টিকোণ থেকে ঈশ্বরকে দেখছে, কিন্তু তারা সবাই এক এবং অভিন্ন ঈশ্বরকেই দেখছে, তখন বিভাজনের নয়, ধর্ম ঐক্যবদ্ধ করার একটি শক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে।
আর সে-কারণে বাহা’ইরা সেই আন্দোলনে সুপরিচিত, যা পৃথিবীর ধর্মগুলোকে একটি নতুন ধরনের বৈশ্বিক ঐক্যে একত্রিত করতে চায়, যার নাম ‘ওয়ার্ল্ডস পার্লামেন্ট অব রেলিজিয়ন। শিকাগো শহরে ১৮৯৩ সালে এটি প্রথমবারের মতো একটি সম্মেলনে একত্রিত হয়েছিল, তারপর এর একশো বছর পরে ১৯৯৩ সালে এটি আরেকটি অধিবেশন করে। এর সবচেয়ে সাম্প্রতিক সভাটি হয়েছে ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে ইউটাহ’র সল্ট লেক সিটি শহরে। এই পার্লামেন্ট একটি ইঙ্গিত যে, আমাদের এই সময়ে, কিছু ধর্ম বন্ধুত্ব আর আলাপচারিতার একটি নতুন যুগে প্রবেশ করতে বহুবছরের বিভাজন আর পারস্পরিক সন্দেহ থেকে তাদের মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
এছাড়াও ঈশ্বর আর মানবতার ঐক্যের প্রতি তাদের এই বৈশ্বিক সাক্ষ্য ছাড়াও, বাহা’ই অনুসারীদের নিজস্ব খুব সরল আর স্বতন্ত্র ধরনের আধ্যাত্মিক অনুশীলনের আচার-অনুষ্ঠান আছে। তাদের কোনো নিবেদিত যাজক বা পুরোহিতশ্রেণি নেই, এবং একই সাথে তারা এর সদস্যদের ওপর কোনো মতবাদের অভিন্নত্ব চাপিয়ে দেয় না। তাদের বিশ্বাসটি হচ্ছে একটি গার্হস্থ্য ধর্মবিশ্বাস, এর আচার মূলত শুরু হয় তাদের নিজস্ব বৈঠকখানা থেকে। কিন্তু সেগুলো বাহা’ই মতবাদের সূচনা যে ইসলামের মধ্যে হয়েছে, সেটি প্রতিফলিত করে। আচার অনুসারে নিজেদের ধৌত করার পর, তারা একটি সুনির্দিষ্ট দিকে মুখ করে প্রার্থনা করেন। তারা মক্কা-অভিমুখে নয়, বরং তারা ইজরায়েলে অবস্থিত তাদের নবী বাহা’উল্লাহর সমাধির দিকে মুখ করে প্রার্থনা করে থাকেন। এবং তাদের প্রার্থনা খুব সরল, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, ও আমার ঈশ্বর, তোমাকে জানতে আর উপাসনা করতে তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ… তুমি ছাড়া আর কোনো ঈশ্বর নেই, আমাদের বিপদে সহায়…’।
বাহা’ই ধর্মটি আমাদের সময়ের ধর্মগুলোর মধ্যে অতীতের বিভাজন ফেলে এসে একটি নতুন ভিন্নধরনের ঐক্যের পথে অগ্রসর হবার প্রবণতার একটি উদাহরণ। এবং এটি সেইসব পদ্ধতি থেকে আসে না, যারা বিভিন্ন গোষ্ঠীকে জোরপূর্বক একটি একক প্রতিষ্ঠানের অধীনে নিয়ে আসার জন্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার করেন। বরং এটি সেই কাজটি করে একটি ঐক্যতা আর সমগ্রতাকে উন্মোচন করে, যা ইতিমধ্যেই সেখানে উপস্থিত : আমাদের সমগ্র মানবতার সাধারণ ঐক্যতা। আর কথা বলার মাধ্যমে নয় বরং আরো বেশি শোনার মাধ্যমেই কেবল আমরা এটি আবিষ্কার করতে পারব। কারণ বিশৃঙ্খল হট্টগোলের মধ্যে নয়, এটি বেশি প্রকাশিত হয় নীরবতায়।
তবে এটি বিশ্বজনীন প্রবণতা হয়ে ওঠা থেকে এখনো অনেক দূরে। এর বিপরীতমুখী একটি প্রবণতা এটিকে ভারসাম্যে আটকে রেখেছে। আর এটি করছে সেই ক্ষুব্ধ মৌলবাদীরা, যারা নিজেদের ঈশ্বরের সত্যের একমাত্র মালিক ও রক্ষাকর্তা হিসাবে দেখে থাকেন। আর তারাই বর্তমান এই পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিততম কিছু সহিংসতার জন্যে দায়ী। আমরা পরের অধ্যায়ে তাদের কাহিনি শুনব।
৩৮. ক্রুদ্ধ ধর্ম
ফান্ডামেন্টালিস্ট বা মৌলবাদী হচ্ছে একটি লেবেল বা মোড়ক, যা বেশকিছু ধর্মীয় গোষ্ঠীর সাথে আজ যুক্ত হয়ে গেছে, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে আমেরিকার প্রটেস্টান্টবাদের একটি বিশেষ ধারাকে বর্ণনা করতে এটি প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল। আধুনিক বিজ্ঞান তখন ঐসব খ্রিস্টানদের জীবন ক্রমশ আরো বেশি। জটিল করে তুলছিল, যারা তাদের বাইবেলকে আক্ষরিক অর্থে বিশ্বাস করতেন। বাইবেল তাদের বলেছিল, মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতে ঈশ্বরের ছয়দিন লেগেছিল এবং সপ্তম দিনে তিনি বিশ্রাম নিয়েছিলেন। এবং ষষ্ঠ দিনে একটি সুনির্দিষ্ট সময়ে তিনি সম্পূর্ণভাবে গঠিত মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন। ঊনবিংশ শতক অবধি অনেকেই। ভেবেছিলেন এভাবে আসলে সবকিছু ঘটেছিল। তারপর সত্যিকারের বিজ্ঞানীরা এই খেলায় প্রবেশ করেছিলেন এবং তারা এই ধারণাটিকে প্রশ্ন করতে শুরু করেছিলেন। তাদের একজন বিশ্বাসীদের বিশেষ মাথা ব্যথার কারণ হয়েছিলেন।