সুতরাং এটি বেশ কৌতূহল উদ্রেক করে যখন কিনা বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি একুমেনিকাল ধর্মটির উৎস কিন্তু হিন্দুবাদে না বরং ইসলামের অভ্যন্তরে। এটির নাম বাহা’ই। এটি ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু হয়েছিল পারস্যে, বর্তমানে যে-দেশটির নাম ইরান। খ্রিস্টধর্ম আর ইসলামের মতো, বাহাই ধর্ম ঐতিহ্যবাহী ভবিষ্যসূচক ধর্মগুলোর মতো। তবে এই ভবিষ্যদ্বাণীর মূল বিষয়টি হচ্ছে ঈশ্বরের মন উন্মোচিত হতে পারে বিশেষভাবে নির্বাচিত কিছু পুরুষের মনে–হ্যাঁ, তারা সাধারণত পুরুষ–তারা যা কিছু দেখেছেন বা শুনেছেন সেটি প্রচার করে থাকেন। এই শিক্ষাগুলো সারাবিশ্বের সামনে উপস্থাপন করতে সমবিশ্বাসীদের একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইসলাম এই ভবিষ্যসূচক বার্তাটি উদযাপন করে, যা এসেছে আব্রাহাম থেকে যিশুর মাধ্যমে মুহাম্মদের কাছে। কিন্তু এটি বিশ্বাস করে, মুহাম্মদই হচ্ছে শেষ নবী, চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি, অথবা যেখানে এসে এই ঐশী প্রত্যাদেশের প্রবাহ এর নিখুঁত পরিপূর্ণতা পেয়েছিল। সব নবীদের শেষ সিলমোহর। নদী অবশেষে তার হৃদ খুঁজে পেয়েছে এবং এই ভবিষ্যদ্বাণীর সমাপ্তি হয়েছে।
কিন্তু বাহা’ইরা বিষয়টি এভাবে দেখেন না। তাদের কাছে এখানে কোনো হৃদ নেই, কোনো বাঁধ নেই, যা ঈশ্বরের ঐশী উন্মোচনের পথটিকে রুদ্ধ করে রাখতে পারে। এই নদী এখনো প্রবাহিত হচ্ছে এবং প্রফেসি বা ভবিষ্যদ্বাণী এখনো প্রবাহিত আছে। এটি চলমান থাকবে, ইতিহাস যতদিন চলবে। কিন্তু মাঝে মাঝে কোনো নতুন নবীর কাছে ঐশী প্রত্যাদেশ হিসাবে এটি বুদ্বুদের মতো উপরে ভেসে উঠে আসে। বাহা’ইরা বিশ্বাস করেন ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইরানে এভাবেই। এটি পৃষ্ঠদেশে উঠে এসেছিল, যখন ঈশ্বর তার সাম্প্রতিকতম নবীকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। আপনি মনে করতে পারবেন গসপেল আমাদের বলেছিল যিশুখ্রিস্টের আবির্ভাবের আগেই তার জন্যে ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করেছিলেন এমন একজন অগ্রদূত ছিলেন, যার নাম ছিল জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট। মানুষ জনকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তিনিই মেসাইয়া কিনা। তিনি বলেছিলেন, তিনি মেসাইয়া না, কিন্তু তিনি এসেছেন, যিনি পরে আসছেন, তার জন্য পথ প্রস্তুত করতে।
একই জিনিস ঘটেছিল ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ইরানে। বাব’ (বা দরজা) নামের একজন তরুণ ঘোষণা করেছিলেন, তিনি হচ্ছেন ঈশ্বরের একজন বার্তাবাহক, এবং পরবর্তী নবীর আগমনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতেই তিনি এসেছেন। বাব নিজে নবী নন, কিন্তু নবীদের জন্য স্বাভাবিক একটি নিয়তি তাকে সহ্য করতে হয়েছিল। তিনি নিজেকে শুধুমাত্র একটি দরজা হিসাবে দাবি করেছিলেন, যার মধ্যে দিয়ে। একজন নতুন নবী পৃথিবীতে প্রবেশ করবেন, তার এই দাবিটি মূলধারার মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি ধর্মদ্রোহিতা হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিল। কারণ। তাদের জন্য মুহাম্মদই ছিলেন শেষ নবী আর তার পরে আর কেউই নবী হতে পারবেন না। সুতরাং ১৮৫৫ সালে বাবকে গ্রেফতার ও পরে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল।
এর কয়েক বছর পরে মির্জা হুসাইন আলি নুরি নামের একজন ব্যক্তি, বাবকে অনুসরণ এবং বাবের ভবিষ্যদ্বাণীর সেই নবীর জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করার কারণে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছিল। তিনি একটি ঐশী প্রত্যাদেশ পেয়েছিলেন, যার মাধ্যমে তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, তিনি নিজেই হচ্ছেন বাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা সেই নবী, এতদিন ধরে তিনি যার অনুসন্ধান করছেন। তিনি বাহাউল্লাহ নাম নিয়েছিলেন, যার মানে ঈশ্বরের মহিমা এবং এভাবেই বাহাই ধর্মবিশ্বাসটির সূচনা হয়েছিল। বাহা’উল্লাহর ভাগ্য বাবের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ভালো ছিল। ইরানি কর্তৃপক্ষ তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়নি, তবে পরবর্তী চল্লিশ বছর তাকে কারাগার আর নির্বাসনে কাটাতে বাধ্য করা হয়েছিল। প্যালেস্টাইনের জেল-নগরী আক্রেতে তিনি ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন আরো একটি উদাহরণ, কীভাবে একটি নতুন ধর্ম শুরু করার ব্যাপারটি আপনার স্বাস্থ্যের জন্যে গুরুতর হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
তার ছেলে আব্দুল বাহা, যিনি তার পিতার মতোই বেশি সময় কারাগারেই কাটিয়েছিলেন, তার উত্তরসূরি হিসাবে বাহা’ইদের নেতা হয়েছিলেন। আর ১৯০৮ সালে যখন তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তিনি মিশর, ইউরোপ আর আমেরিকায় ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেছিলেন তার নতুন বিশ্বাসের সংবাদটি প্রচার ও অনুসারী সংগ্রহ করতে। যখন ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন, নেতা হিসাবে তার জায়গা নিয়েছিলেন তারই নাতি, শোঘি এফেন্ডি। বাহা’ইদের বিশ্বাসটি ক্রমশ বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হতে আর পরিচিতি পেতে শুরু করেছিল। আর ১৯৫৭ সালে যখন শোঘি এফেন্ডি লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, এই আন্দোলনের নেতৃত্ব একক ব্যক্তির, যিনি কিনা কোনো নবীর উত্তরসূরি, হাত থেকে হস্তান্তরিত হয়েছিল বিশ্বাসীদের একটি গোষ্ঠীর কাছে, যারা পরিচিত ইউনিভার্সাল হাউজ অব জাস্টিস’ নামে।
বাহা’ই ধর্মের সৌন্দর্যটি হচ্ছে এই ধর্মবিশ্বাসটিতে কোনো ধরনের জটিলতা নেই। এর মূল ধারণাটি হচ্ছে অগ্রগতিশীল একটি ঐশী উন্মোচন বা প্রত্যাদেশ। ঈশ্বর নবী পাঠানো অব্যাহত রেখেছেন, যাদের মধ্যে ঘটনাক্রমে বাহাউল্লাহ ছিলেন সবচেয়ে সাম্প্রতিকতম একজন। তার মানে এই নয় যে, বাহাউল্লাহই হচ্ছেন সর্বশেষ ঐশী নির্দেশ পাওয়া কোনো নবী। এর মানে শুধু আপাতত এই সময়টির জন্যে মানবতার উচিত হবে তার প্রতি মনোযোগ দেওয়া। কারণ, তিনি হচ্ছেন ঈশ্বরের সাম্প্রতিকতম বার্তাবাহক, যার কাছ থেকে আমরা শিক্ষাগ্রহণ করতে পারি। এটি খুব সরল একটি শিক্ষা, যা সেই সময়ের একুমিনেকাল বা বিশ্বাসের ঐক্যসংক্রান্ত প্রাণশক্তিটিরই প্রতিধ্বনি করেছিল। ঈশ্বর একক ও অদ্বিতীয়, যার সত্তার প্রকৃতি মানুষের বোধগম্যতার সীমার বাইরে। নবীরা ঈশ্বরের মনটিকে শুধুমাত্র একঝলক দেখতে পান। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, যে-ধর্মগুলো গড়ে ওঠে ঈশ্বরের মনের এই ক্ষণিক দৃশ্যগুলোর ওপর ভিত্তি করে, সেগুলো সবসময়ই একটি বিষয়ে ভুল করে থাকে। আর তাদের এই ভ্রান্তিটি সবসময়ই একই রকম, তারা মনে করেন তাদের ধর্মটিই হচ্ছে ঈশ্বরের শেষ কথা।