ষোড়শ শতাব্দীর রিফরমেশন আন্দোলনটি খ্রিস্টানদের পরস্পর যুদ্ধরত বহু দল আর উপদলে বিভাজিত করেছিল। এবং তারা যখন পরস্পরকে হত্যা করা বন্ধ করতে পেরেছিলেন, তার পরের কয়েক শতাব্দী তারা পরস্পরকে অবজ্ঞা আর উপেক্ষা করেই কাটিয়েছিলেন। প্রতিটি ধর্মগোষ্ঠী নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থেকেছিল, নিজেদের মতো করেই তারা তাদের জীবন কাটিয়েছে। কিন্তু তারপর সেই ভারী দরজাটি ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করেছিল। আর খ্রিস্টানরা বাইরে বের হয়ে এসেছিলেন এবং তাদের পরস্পরের মধ্যে সৃষ্টি করা সেই উঁচু বিভেদের দেয়ালের ওপর থেকে পরস্পরের সাথে কথা বলতে শুরু করেছিলেন। এই মতবিনিময়ের পর্বটি শুরু হয়েছিল ১৯১০ সালে এডিনবরায় অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলন থেকে, যেখানে বেশকিছু প্রটেস্টান্ট মিশনারি সোসাইটির প্রতিনিধিরা তাদের সমষ্টিগত নানা সমস্যা নিয়ে একত্রে আলোচনায় বসেছিলেন। তারপর ১৯৩৮ সালে জাতিসংঘের মডেল অনুসরণ করে একশোটি চার্চের নেতাদের ভোটের মাধ্যমে একটি ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব চার্চ’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু ১৯৩৯ সালের বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই প্রতিষ্ঠানটির উচ্চাকাঙ্ক্ষায় খানিকটা বিরতি এসেছিল। কিন্তু আবার ১৯৪৮ সালে ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব চার্চ তার প্রথম অধিবেশনটির আয়োজন করেছিল, যেখানে ১৪৭টি চার্চের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। বর্তমানে ৩৪৫টি ভিন্ন চার্চ সম্প্রদায় এর সদস্য, আর এই সংখ্যাটি স্মরণ করিয়ে দেওয়া খ্রিস্টধর্ম এখনো কত বেশি খণ্ডিত।
শুরুর বছরগুলোয় একুমেনিকাল আন্দোলন একটি পুনর্মিলনীর আশা করেছিল, বিভাজিত খ্রিস্টান সম্প্রদায়গুলোকে একটি একক সম্পূর্ণতায় নিয়ে আসা, একটি একক চার্চ। যদিও নিখুঁত উদাহরণ নয়, তবে এটিকে পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী বেশকিছু প্রতিষ্ঠানকে একটি বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অধীনে একীভূত করার মতো কিছুর সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এটি মূলত প্রকৌশলের একটি মডেল। এখান থেকে কিছু নিয়ে, অন্যটার সাথে কিছু যুক্ত করে, তাদের একসাথে শক্ত করে পেরেক দিয়ে জোড়া লাগানো, ব্যস, তারপর হয়ে গেল একটি ইউনাইটেড চার্চ! অল্প কয়েকটি প্রটেস্টান্ট চার্চই এভাবে নিজেদের একীভূত করতে সফল হয়েছিলেন। যেমন, ইউনাটেড চার্চ অব ক্রাইস্ট, ১৯৫৭ সালে দুটি পৃথক খ্রিস্ট-সম্প্রদায় একত্রে যুক্ত হয়ে যা তৈরি করেছিল। এবং অষ্ট্রেলিয়ার ‘ইউনাইটিং চার্চ’ একীভূত হয়েছিল ১৯৭৭ সালে, যখন তিনটি পৃথক গোষ্ঠী যুক্ত হয়েছিল। এই অল্পকিছু স্থানীয় সফলতা ছাড়া, এই ধরনের একতা সৃষ্টি করার সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু এই প্রচেষ্টা চার্চগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল।
এই একতার অনুসন্ধানকে পরে প্রতিস্থাপিত করেছিল আরো খানিকটা শিথিল দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে চার্চগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যদিও তারা পরস্পরের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে চান না ঠিকই, কিন্তু পরস্পরের বন্ধু হতে না-পারার কোনো কারণ তারা দেখেননি। এটি সহজতর হয় যদি তাদের মধ্যে আগে থেকেই সাধারণ কিছু থাকে এবং তারা পার্থক্যগুলোকে উপেক্ষা করতে প্রস্তুত থাকে। একুমেনিকাল আন্দোলনের নিজস্ব ভাষায়, এরপর তারা পরস্পরের সাথে কমিউনিয়নের বন্ধনে আবদ্ধ হবে। সুতরাং ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের অ্যাঙলিকান চার্চ ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে উত্তর-ইউরোপের লুথারিয়ান চার্চের সাথে একটি কমিউনিয়নে যুক্ত হয়েছিল। তারা একীভূত হয়ে যায়নি এবং নতুন কোনো সম্প্রদায়ে পরিণত হয়নি। তারা নিজেদের বাড়িতেই রয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু পরস্পরের জন্যে তারা তাদের দরজা উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন, এবং সম্প্রসারিত একটি পরিবারে পরিণত হয়েছিল।
এইসব একুমেনিকাল কর্মকাণ্ড খ্রিস্টধর্মকে কোথায় নিয়ে যাবে এখনো সেটি বলার মতো সময় হয়নি। তবে একটি সম্ভাব্য তথ্যপুষ্ট অনুমান হচ্ছে কোনো পরিকল্পিত পদক্ষেপ বা প্রকৌশলের মাধ্যমে একতা প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টার দিন শেষ হয়ে গেছে। আরো শিথিল একটি পদ্ধতি এর জায়গা নিয়েছে এবং যেখানে মনে করা হয় বিভিন্ন চার্চগুলোর মধ্যে পার্থক্যটিকেই আমাদের উদ্যাপন এবং লালন করতে হবে। কারণ আর যাই হোক, প্রতিটি পরিবারের একটি নিজস্ব শৈলী আছে, কোনোকিছু করার একটি উপায় আছে, কিন্তু সবাই বিশ্বব্যাপী একটি মানবসমাজের সদস্য। যে দৃষ্টিভঙ্গিটি ভিন্নতাকে লালন করে সেটির আবির্ভাব ঘটতে শুরু করেছে। কারণ কয়েক হাজার খ্রিস্ট-সম্প্রদায়কে একসাথে জোড়া লাগিয়ে কোনো একটি বড় প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করার খুব সামান্যই সুযোগ আছে। কিন্তু এটি এর এই বহুত্বের মধ্যে সৌন্দর্য আর সদগুণ লক্ষ করতে শুরু করেছে। কোনো একটি বাগানের মতো যেখানে শত শত ফুল ফোটে। বহুবিধ উপায়ে ঈশ্বরকে বোঝা আর উপাসনা করা যেতে পারে।
এটি শুনলে পাশ্চাত্য নয় বরং প্রাচ্যের একটি ধারণা মনে হয়, খ্রিস্টধর্মের চেয়ে আরো বেশি হিন্দুধর্মীয়। আর এর কারণ হচ্ছে, এটি আসলেই সেটাই। একুমেনিকাল আন্দোলন হয়তো খ্রিস্টান ধর্মকে একীভূত করার প্রচেষ্টা শুরু করেছিল ১৯১০ সালে, তবে এটি করার সেই তাগিদের উপস্থিতি ছিল এর আরো বহুদিন আগে থেকেই। আমরা ইতিমধ্যেই এটিকে কাজ করতে দেখেছি শিখ মতাদর্শে, যেখানে অন্য ধর্মবিশ্বাসের ঐতিহ্যের প্রতি একটি উন্মুক্ত মনোভাব আছে। এখানে এটি হিন্দুধর্মের সেই রূপকটিকে প্রতিফলিত করছে, পানির বহু স্রোতধারা একটি সাগরে মিশে যেতে প্রবাহিত হচ্ছে। আর এটি এমন কোনো। ধারণা নয়, যা হয়তো নবী মুহাম্মদের মনে আবেদন সৃষ্টি করতে পারত, যিনি ইসলামকে বহু ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে একটি হিসাবে দেখেননি, বরং এদের পরিসমাপ্তি আর পরিপূর্ণ একটি রূপ হিসাবে দেখেছিলেন।