আর এখানে বিষয়গুলো আরো বেশি জটিল হয়ে উঠতে শুরু করে। পৃথিবীর সব ধর্মগুলোই অশুভ বিষয় আর দুঃখকে ব্যাখ্যা আর সেটি একটি প্রতিকার সরবরাহ করার চেষ্টা করেছে। বাইবেল যেমন অদ্বিতীয় ঈশ্বরের অবাধ্য হয়ে করা একটি কাজকে এর জন্য দায়ী করেছিল, ঈশ্বরের করুণা আর দয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার মতো একটি পতন, যার কারণে ইডেন থেকে আদম আর হাওয়াকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। আর মানব-ইতিহাস সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত আর স্বর্গে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবার একটি অনুসন্ধানে পরিণত হয়েছিল। হিন্দু ধর্মতত্ত্বে এটি ছিল কার্মা, কর্মের সূত্র, আমাদের যা বহু মিলিয়ন জীবনের চক্রের মধ্যে প্রচলিত করে, এতদিন-না আমরা সব পাপ থেকে মুক্ত হতে পারি এবং পরিশেষে নির্বাণে মুক্ত হতে পারি। সায়েন্টোলজি-এর শিক্ষায় এই দুটি জায়গা থেকেই প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করেছিল।
বহু মিলিয়ন জীবনের মধ্যে দিয়ে তাদের এই পরিক্রমায় থিটানরা তাদের কাটানো জীবনগুলোর অভিজ্ঞতার আঘাতজনিত কারণেই আবেগীয় এবং মনোজাগতিক স্তরে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। এটি তাদের ক্ষতিগ্রস্ত আর দুর্বল করে। তোলে, যেভাবে খুব সহিংস কোনো শৈশব একজন মানুষের প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের ওপর ছায়া ফেলে। আর এই ক্ষতিকর অভিজ্ঞতাগুলোর কিছু ঘটে দুর্ঘটনাবশত। হুবার্ড তাদের বলেছিলেন এনগ্রামস। এগুলো শুধুমাত্র ক্ষত, যা এক সময় থিটানদের ওপর ফেলে যায়, যখন তারা বহু মিলিয়ন জীবনের মধ্যে তাদের ভ্রমণ। করে থাকে, যা মূলত সাধারণ কাটাছেঁড়ার মতোই। কখনো এই ক্ষতি পরিকল্পিত এবং উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত, যা থিটানরাই আরোপ করে, যারা অশুভ দিকে ঝুঁকে পড়েছিল এবং অন্য থিটানদের ওপর যারা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।
হুবার্ড মানবমনের ওপর এইসব পরিকল্পিত ক্ষতগুলোর নাম দিয়েছিলেন ‘ইমপ্লান্টস’। এগুলো শুধুমাত্র শারীরিক কিংবা মানসিক যন্ত্রণারই মূল উৎস নয়, এগুলো খারাপ ধারণারও উৎস, যা পরিকল্পিতভাবে থিটানদের দিভ্রান্ত করে বিপথে পরিচালনা করতে রোপণ করা হয়েছে। তিনি লিখেছিলেন : ‘এই ইমপ্লান্টের পরিণতি হচ্ছে নানা ধরনের অসুখ, উদাসীনতা, পদভ্রষ্টতা, নিউরোসিস আর মানসিক অসুস্থতা’। আর মানুষের সব দুর্গতির কারণই হচ্ছে এটি। তিনি বলেছিলেন, স্বর্গ-সংক্রান্ত খ্রিস্টীয় ধারণাটি ৪৩ মিলিয়ন বছর আগে মানবমনের মধ্যে প্রবিষ্ট করা হয়েছিল। আর প্রতারণার একটি কৌশল হিসাবে খুব সতর্কভাবে পরিকল্পিত দুটি ইমপ্লান্টই মূলত থিটানদের ভাবতে প্ররোচিত করেছিল যে, অসীমসংখ্যক ধারাবাহিক জীবনের বদলে তারা একটি মাত্র জীবন পাবেন।
এনগ্রাম আর ‘ইমপ্লান্টগুলো হচ্ছে সায়েন্টোলজির একটি সংস্করণ, খ্রিস্টধর্মে যেটিকে বলা হয় পতন বা ‘দ্য ফল’। মানব-দুর্দশার ব্যাখ্যা হচ্ছে এগুলো। এবং যা আমাদের আক্রান্ত করেছে তার জন্যে সায়েন্টোলজির নিরাময়টি একইভাবে সুনির্দিষ্ট। এনগ্রামগুলো নিজেদের মানুষের অবচেতন বা হুবার্ডের ভাষায় ‘রিঅ্যাকটিভ মাইন্ড’ বা ‘প্রতিক্রিয়াপ্রবণ’ মনের সাথে যুক্ত করে ফেলে, যা আমাদের জীবনে হতাশাগুলোকে উসকে দেয়। এর থেকে মুক্তি আসে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় বিশোধন বা সেগুলোকে ‘পরিষ্কার করার মাধ্যমে, যে-প্রক্রিয়াটিকে ‘অডিটিং’ বলা হয়। শুনলে মনে হতে পারে একজন কাউন্সিলর কোনো রোগীর কথা শুনছেন, যিনি ধীরে ধীরে অতীতের কোনো ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন, বর্তমানে যা তার হতাশার কারণ। কিন্তু সায়েন্টোলজি সেভাবে কাজ করে না। অডিটররা শোনেন তবে সেটি করার জন্যে তারা প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। তাদের একটি যন্ত্র আছে, যাকে বলা হয় ইলেক্ট্রোসাইকোমিটার অথবা ই-মিটার, যা লাই-ডিটেক্টর যন্ত্রের মতো কাজ করে। এই ই-মিটার অডিটরদের সেই প্রশ্নগুলো খুঁজতে সহায়তা করে, যা মনের গভীরে ডুবে-থাকা স্মৃতিকে চেতনার স্তরে উন্নীত করে নিয়ে আসে। প্রতিটি এধরনের সেশনের উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি ‘উইন’ বা উন্মোচনের একটি মুহূর্ত। এই ‘উইন’ অপরাধী অভিজ্ঞতাগুলোকে চেতনার উপরের স্তরে নিয়ে আসে এবং যেখানে যন্ত্রটি ইলেক্ট্রিক শক দিয়ে এটি বিলুপ্ত করে দেয়। এমন নয় যে, ঘটনাটি মনে করা হয়েছে এবং তারপর এটি নিরাময় হয়েছে। এটি স্মৃতি থেকেই চিরতরে সরিয়ে দেওয়া হয়। অতীতের কোনোকিছুর জন্য স্বীকারোক্তি করা হয় না বা এর জন্য প্রায়শ্চিত্ত করা হয় না, এটি মন থেকে মুছে ফেলা হয়।
সায়েন্টোলজিতে এটি ছাড়াও অন্য আরো পরিত্রাণমূলক কৌশল আছে, যার মাধ্যমে এটি এর অনুসারীদের নিজস্ব সংস্করণের একটি পরিত্রাণ সরবরাহ করে। কিন্তু এই পরিত্রাণটি খুবই বিশেষায়িত অর্থে। এটি এই জীবনেই সীমাবদ্ধ, যে জীবন এই মুহূর্তে বিশ্বাসীরা কাটাচ্ছেন। সুতরাং কোনো চূড়ান্ত মুক্তি কিংবা নরকদণ্ড নেই। কোনো স্বর্গ বা নরক নেই। জীবন মাত্র একবার কাটানোর বিষয় নয়। শুধুমাত্র এই জীবনের পরে অন্য জীবনে চিরন্তন প্রত্যাবর্তন। এটি একটি ‘সামসারা’ যেখানে নির্বাণ নেই। আর সায়েন্টোলজি যা করে সেটি হচ্ছে, আপনার শরীর থেকে এনগ্রামগুলো বিশোধন আর ইমপ্লান্টগুলোর উপস্থিতির স্বীকৃতি দিয়ে আপনার সাম্প্রতিক জীবনটিকে উন্নত করে তোলে।