এছাড়া যে-অনুধাবনটি তার মনে এসেছিল সেটি হচ্ছে : অসুখের ভিত্তি হচ্ছে একটি বিভ্রম বা মায়া। আর সেই মায়াটি হচ্ছে পদার্থের একটি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে বলে মনে করা। কিন্তু পদার্থের সে-ধরনের কোনো অস্তিত্ব নেই। এগুলো সৃষ্টি করেছে ঈশ্বরের মন। মন হচ্ছে এর কারণ। পদার্থ হচ্ছে এর ফলাফল। সুতরাং নিরাময় পাবার উপায় হচ্ছে বস্তু বা পদার্থের ওপরে মনের ব্যবহার। এভাবে তিনি তার সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ’ বইটিতে লিখেছিলেন : ‘মানুষের জ্ঞান এগুলোকে পদার্থের শক্তি নামে ডাকে। কিন্তু স্বর্গীয় বিজ্ঞান ঘোষণা করেছে যে, সেগুলো সম্পূর্ণভাবেই স্বর্গীয় মনের অংশ… আর এই মনেরই অন্তর্গত অংশ। বস্তুর ওপর মন, এই মূলনীতি মানব দুঃখ লাঘবে ব্যবহার করা মানে স্বীকৃতি দেওয়া, যে-অসুখগুলো আমাদের আসলে আক্রান্ত করেছে সেগুলোর কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। এগুলো ছলনা, বিভ্রম, মায়া, মনের ওপর বস্তুর কারসাজি। আর আরোগ্যলাভের উপায় তাই ডাক্তারদের মাধ্যমে নয়, যারা একই খেলা খেলছেন, বস্তুবাদী খেলা। ঈশ্বরের ভালোবাসার শক্তির সামনে নিজেদের উন্মোচন করার মাধ্যমেই কেবল আরোগ্য আসে, আমাদের সুস্বাস্থ্য আর বাস্তবতাটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে, যা এই অসুস্থতার বিভ্রমটি দূর করে। ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স আমাদের অসুস্থতা থেকে আরোগ্য দান করছে না। এটি সেই বিভ্রমটি থেকে আমাদের মুক্তি দেয়, যা আমাদের বিশ্বাস করিয়েছিল যে, আমাদের সেই অসুখটি আছে!
আর এটি এমন কোনো মতবাদ ছিল না, যা-কিনা নিউ ইংল্যান্ডের মূলধারা চার্চগুলো মেনে নিতে প্রস্তুত থাকতে পারে। তারা বিশ্বাস করতেন না যে, এত সহজেই মানব-দুর্দশা লাঘব করা সম্ভব হতে পারে। এর আসলেই অস্তিত্ব আছে, কোনো বিভ্রম নয়। তারা সন্দেহ করেছিলেন, মেরি বেকার, ‘পাপ’ আর ‘স্বর্গীয় বিচারে’ বাস্তবতা কিংবা স্বর্গ আর নরকের ধারণাটি বিশ্বাস করেন না। আর তিনিও আসলেই তা বিশ্বাস করতেন না। তার বইয়ে সবার জন্যে পরিত্রাণের নিশ্চয়তা ছিল। আর কোনো সমস্যাই সমাধানের ঊর্ধ্বে নয়, একবার যখন বস্তুর ওপর মনের সেই মূলনীতিটি বোঝা সম্ভব হবে। তার এই আবিষ্কারের সাথে মূলধারা চার্চের বিরোধিতায় হতাশ হয়ে, মেরি ১৮৭৯ সালে বোস্টনে, তার তৃতীয় স্বামী এ. গিলবার্ট এডিকে নিয়ে (যাকে তিনি ১৮৭৭ সালে বিয়ে করেছিলেন) চার্চ অব। ক্রাইস্ট সায়েন্টিস্ট’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯০৮ সালে তিনি একটি সংবাদ পত্রিকাও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ‘দ্য ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর’, যা এখনো প্রকাশিত হয় এবং ব্যাপকভাবে সম্মানিত। একই সাথে বিখ্যাত মাদার’ চার্চ অব ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স’টিও, যা বোস্টনের ব্যাক বে এলাকায় চৌদ্দ একরের একটি বিশাল ভূমির উপর দাঁড়িয়ে আছে।
ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্সের ধর্মীয় সভায় মূলত বাইবেল এবং মেরি বেকার এডির মূল কাজ থেকে পড়া হয়, বিশেষ করে তার সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ’ বইটি। এছাড়া স্তব সংগীত গাওয়া হয় এবং নীরবতা পালন করা হয়। কিন্তু শুধুমাত্র একধরনের প্রার্থনা ব্যবহার করা হয়, সেটি হচ্ছে লর্ডস প্রেয়ার। ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স কখনোই ব্যাপক গণআন্দোলনে পরিণত হতে পারেনি কিন্তু পৃথিবীর বহু জায়গায় এটি বিস্তার লাভ করেছিল। বহু শহরেই আপনি এই ধর্মগোষ্ঠীর কোনো একটি রিডিংরুম পাবেন, যেখানে মেরি বেকার এডির লেখা প্রদর্শনীতে সংরক্ষিত আছে, আর আপনি খুঁজে বের করতে পারেন, কীভাবে বস্তুর ওপর মনের সেই মূলনীতিটি, আপনাকে আক্রান্ত কোনো অসুখ থেকে মুক্তি পাবার উদ্দেশ্যে আপনি ব্যবহার করবেন। ১৯১০ সালে বোস্টনের একটি শহরতলীতে তার নিজের বাড়িতে মেরি বেকার মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
চল্লিশ বছর পরে, ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে, আরেকটি আমেরিকান ধর্মের জন্ম হয়েছিল, যা ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্সের চেয়ে আরো অনেক বেশি আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বিরোধী ছিল। এই ধর্মগোষ্ঠীটি তাদের নাম দিয়েছিল, চার্চ অব সায়েন্টোলজি’, এবং এর নবী ছিলেন কল্প-বিজ্ঞানের একজন লেখক, লাফায়েট রোনাল্ড হুবার্ড, যিনি ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের নেব্রাস্কায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। হলিউডের তারকাদের মধ্যে এই ধর্মটি বেশ জনপ্রিয়। টম ক্রুজ আর জন ট্রাভোল্টা তাদের পেশাগত সাফল্যের জন্যে এই ধর্মের অনুশীলন আর মূলনীতির কাছে ঋণস্বীকার করেছিলেন। সায়েন্টোলজি আধুনিক প্রযুক্তি এবং মনো-বিশেষণের নানা কৌশল ব্যবহার করে থাকে। এর ভিত্তিমূলক দর্শনটি হচ্ছে পুনর্জন্ম-সংক্রান্ত প্রাচীন হিন্দু মতবাদ বা সামসারা’। এটি ‘থিটানস’ নামক একধরনের অমর আত্মাদের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে, যারা বহু ট্রিলিয়ন বছর ধরে একটি শরীর থেকে অন্য শরীরে প্রচরণ/ভ্রমণ করে আসছে। সায়েন্টোলজিতে এর খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে নিশ্চিত হওয়া বেশ মুশকিল, কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে এই থিটানরা কারো দ্বারা সৃষ্ট বলে মনে হয় না। তারা নিজেরাই এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা। আর সেই মহাবিশ্বের মধ্যে তাদের কাজকর্ম পরিচালনার জন্যে তারা নিজেদের জন্য নানাধরনের বাহন সৃষ্টি করেছিলেন, আর মানুষের শরীর হচ্ছে তাদের সৃষ্টি করা বহু রূপগুলোর মধ্যে একটি মাত্র।