প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনায় একধরনের আর্মাগেডন আসলেই ১৯১৪ সালে ইউরোপকে আক্রমণ করেছিল। কিন্তু এমন কিছু নয় যা রাসেল প্রত্যাশা করেছিলেন। এবং যখন তিনি ১৯১৬ সালে মারা যান, তিনি তখনো আসল আর্মাগেডনের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। ওয়াচটাওয়ারের নেতা হিসাবে যে মানুষটি তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন, তিনি ছিলেন খুব দক্ষ একজন ব্যবসায়ী, জোসেফ আর. রাদারফোর্ড। তিনি খুব দ্রুত রাসেলের অনুসারীদের একটি দীর্ঘ আন্দোলনের জন্য সংগঠিত করেছিলেন। ১৯৩১ সালে তিনি তাদের নাম বদলে রাখেন ‘জিহোভাস উইটনেস’। তিনি অনুসারীদের ওপর কঠোর শৃঙ্খলা আর নিয়ম আরোপ করেছিলেন, যা তাদের চারপাশের মূলধারার সমাজ থেকে পৃথক করে রেখেছে। তিনি তাদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে, অন্তর্মুখী করে তুলেছিলেন।
বেশ সাহসের প্রয়োজন হয় যখন কেউ আধুনিক সমাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এর সব মূল্যবোধকে প্রত্যাখ্যান করে, এমনকি যেভাবে এটি চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকে। জিহোভাস উইটনেসের সদস্যরা কোনো রক্ত পরিসঞ্চালন গ্রহণ করেন না। রক্ত তাদের জন্যে জীবন এবং শুধুমাত্র ঈশ্বরই সেটি দিতে পারেন। সুতরাং তারা মাঝে মাঝে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আইনের মুখে পড়েন তখন তারা তাদের শিশুদের শরীরেও রক্ত পরিসঞ্চালন করতে বাধা দেন। আর এভাবে সারা পৃখিবীর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ব্যাপারটি কোনো একটি গোষ্ঠীকে খুব শক্তিশালী আত্মপরিচয়ের একটি অনুভূতি দিতে পারে। আর সব নির্যাতন এই সংকল্পটিকে আরো দৃঢ়তর করে তুলতে পারে। এছাড়া যদি এর বিশ্বাস নিয়ে কেউ মন পরিবর্তন করেন, এমন কোনো পক্ষে সেই গোষ্ঠী থেকে তার হয়ে আসার ব্যাপারটিকেও এটি খুব কঠিন করে তোলে।
রাদারফোর্ড ১৯৪২ সালে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। আমাগেডন তখনো আসেনি, যদিও এর একটি ভালো অনুকরণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন চলছিল। আরো একবার জিহোভাস উইটনেসের সদস্যরা এই হতাশা সহ্য করেছিলেন। নতুন নেতারা ইতিহাসে আরো দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে তাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। খ্রিস্ট অবশ্যই ফিরে আসবেন, সুতরাং নজর রাখা অব্যাহত রাখুন। মর্মনদের মতো, উইটনেস সদস্যরা দ্বারে দ্বারে ঘুরে ধর্ম প্রচার করার ব্যাপারে বেশ উৎসাহী। এবং তাদের আন্দোলনে এভাবে আরো সমর্থক তৈরি করা তারা এখনো অব্যাহত রেখেছেন। তাদের উপাসনালয়গুলোকে চার্চ বলা হয় না, কিংডম হল’ বলা হয়। সারা পৃথিবীজুড়েই তারা তাদের মতাদর্শ প্রচারে একটি ম্যাগাজিন বিক্রয় করে, ‘দ্য ওয়াচটাওয়ার। তারা প্রহরীর মতো নজর রেখেছে এখনো, দিগন্তে চোখ রেখে, যিশুর জন্যে, যিনি রাতে চোরের ছদ্মবেশে ফিরে আসবেন।
সেভেন্থ ডে অ্যাডভেন্টিস্ট আর জিহোভাস উইটনেসের মতো ধর্মগোষ্ঠীগুলো বাইবেলের সবচেয়ে অদ্ভুত আর বিব্রতকর একটি বিষয় আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সেই বাস্তব তথ্যটি : দুই হাজার বছর অপেক্ষা আর নজরদারির পরেও, খ্রিস্ট এখনো ফিরে আসেননি। উদার খ্রিস্টানরা এই সমস্যাটির মোকাবেলা করে থাকেন খানিকটা সূক্ষ্ম উপায়ে। তারা দ্বিতীয় আগমনকে অবিশ্বাস করেন না, কিন্তু কীভাবেই বা তারা সেটি করবেন? কারণ এটি খুব দৃঢ়ভাবে বাইবেলের ভিত্তিতে আছে। তাদের বিশ্বাসে এটি বারবার আলোচিত হয়েছে। ক্রিসমাসের আগের মাসটি- ‘অ্যাডভেন্ট’ –এই বিষয়ের অর্থ নিয়ে ধ্যান করার সময় হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে।
তারা এটিকে মোকাবেলা করার এমন কিছু প্রস্তাব করে যে, ঈশ্বরের সেই রাজ্য ইতিমধ্যে এখানে উপস্থিত। খ্রিস্টানদের যা করতে হবে তা হলো এর প্রমাণ খুঁজে বের করতে হবে। এটির সন্ধান মিলবে যেখানে দরিদ্র আর অসহায়দের সহায়তা করা হবে, অবিচার আর অন্যায়কে চ্যালেঞ্জ করা হবে। এটি সেখানে পাওয়া যাবে, যেখানে ভালো মানুষরা এই পৃথিবীতে আরো উত্তম করে গড়ে তুলতে কাজ করবেন, এমন একটি পৃথিবী হবে সেটি, যা অনেকটাই যিশুর বর্ণিত সেই ঈশ্বরের রাজ্যের মতো। আর এই দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থনে যিশু প্রয়োজনীয় উদ্ধৃতিও আছে। সেগুলো এসেছে এমন একটি বই থেকে, যা নিউ টেস্টামেন্টে জায়গা। পায়নি। যদিও এটি যিশুর সত্যিকারের বক্তব্য ধারণ করে। এটির নাম ‘গসপেল অব টমাস’। এখানে অনুসারীরা যিশুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কখন এই রাজ্যটি আসবে’? যিশু উত্তরে বলেছিলেন, এর জন্যে অপেক্ষা করে বসে থাকলে এটি আসবে না। এটি শুধুমাত্র মুখে বলা কোনো কথার কথা নয়, এখন এসেছে বা ঐ যে আসছে ইত্যাদি, বরং পিতার রাজ্য সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে আছে, আর কেউই সেটি দেখতে পাচ্ছে না।
এই দৃষ্টিভঙ্গিকে দ্বিতীয় আগমনের সত্যিকারের বিশ্বাসীরা দুর্বল একটি ধারণা বলেই মনে করেন। তারা আরো সুস্পষ্ট জীবন্ত কিছু চান। তারা একটি আর্মাগেডন চান। আর আমেরিকার খ্রিস্টধর্ম এই আর্মাগেডন সরবরাহ করতে সফল হয়েছে। হয়তো এর কারণ আমেরিকানরা নিজেদের ঈশ্বর-নির্বাচিত একটি জাতি হিসাবে দেখেন, ব্যতিক্রম একটি জনগোষ্ঠী যাদের ঈশ্বর-নির্দেশিত একটি নিয়তি আছে। আমরা যেভাবে এটি ব্যাখ্যা করি না কেন, খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসে আমেরিকা এমন বহু ধর্মগোষ্ঠী দিয়ে পূর্ণ, যারা পৃথিবীর পরিসমাপ্তি আর খ্রিস্টের ফিরে আসার জন্যে অপেক্ষা করেছেন। এবং তারা এখনো সেটি কামনা করছেন। প্রায়শই নতুন নবীদের আবির্ভাব হয়, যারা ঘোষণা করেন শেষদিন আসন্ন প্রায়। এবং সেই বার্তাটিকে তাদের অনুসারীদের মনের গভীরে প্রবেশ করাতে তারা নতুন আর বিচিত্র নানা উপায়ও খুঁজে নেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে সফল কয়েকটি উপায়ে এই বার্তাগুলো প্রচার করতে একটি দীর্ঘ কাহিনির আশ্রয় নিয়েছে, আর সেটি ধারাবাহিক একটি উপন্যাসের রূপে, যা কেউ তাদের স্থানীয় সুপার মার্কেট থেকে কিনতে পারেন।