অ্যাডভেন্টিস্টদের নবী ছিলেন এলেন হোয়াইট। ১৮২৭ সালে জন্ম নিয়ে তিনি ১৯১৫ সালে মারা গিয়েছিলেন। এবং তার লেখাগুলোই সেভেন্থ ডে অ্যাডভেন্টিস্টদের মধ্যে বাইবেলের মতোই একটি কর্তৃত্ব পেয়েছিল। তারা অন্য বহু ধর্মগোষ্ঠীর মতো খুব কঠোর নৈতিক মূলনীতি অনুসরণ করতেন, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত যেমন নিরামিষ ভোজন, আর তামাক, মদ, নাচ এবং অধিকাংশ ধরনের আমোদপ্রমোদই তাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। তারা ট্রিনিটি আর খ্রিস্টের স্বর্গীয় দেবত্বে বিশ্বাস করতেন। এবং তারা ক্ষমতায় এবং স্বমহিমায় খ্রিস্টের প্রত্যাবর্তন এবং পৃথিবীতে ঈশ্বরের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হবার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তবে মৃত্যুর পর তাদের সাথে কী হবে সেই ধারণায় প্রচলিত বিশ্বাস থেকে তারা ভিন্নমত পোষণ করতেন।
আনুষ্ঠানিক খ্রিস্টধর্মীয় মতবাদ হচ্ছে, শেষবিচারের দিনে সমস্ত মানুষকে দুটি দলে ভাগ করা হবে। একটি দল তাদের অনন্তকাল কাটাবে নরকে, জীবদ্দশায় করা তাদের সব পাপকর্মের শাস্তি হিসাবে। এবং অন্যদিকে সন্মানুষরা স্বর্গের অনন্ত পরমানন্দে বসবাস করার অধিকার অর্জন করবেন। এলেন হোয়াইট এই মতবাদটিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন :
ভালোবাসা আর দয়ার প্রতিটি আবেগের কাছে, এমনকি আমাদের ন্যায়বিচারের ধারণার কাছেও কতটা অসহনীয় আর অগ্রহণযোগ্য হতে পারে এমন কোনো মতবাদ, যা দাবি করছে পাপী মৃতরা অনন্তকাল একটি জ্বলন্ত নরকে আগুন আর গন্ধকে জীবন্ত দগ্ধ হতে থাকবেন, আর সংক্ষিপ্ত পার্থিব জীবনের পাপের জন্যে তাদের এই যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে ঈশ্বর যতদিন বাঁচবেন ততদিন অবধি।
পাপীদের অনন্তকালের নরক-যন্ত্রণায় না পাঠিয়ে, হোয়াইট বলেছিলেন, ঈশ্বর তাদের চিরন্তন বিস্মরণের একটি জগতে প্রেরণ করেন। সম্পূর্ণভাবেই নিশ্চিহ্ন, অনন্ত কালের নরক-যন্ত্রণা ভোগ করাই পাপীদের নিয়তি নয় বরং তারা সম্পূর্ণভাবেই অস্তিত্বহীন আর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন। ‘আর কোনো ঈশ্বর-বিদ্রোহী ভ্ৰষ্ট আত্মাই সেখানে থাকবে না, নরকের গভীরে অনন্ত যন্ত্রণায় কুঁকড়ে থাকা কোনো আত্মা সেখানে থাকবে না, কোনো অভাগা আত্মার আর্তনাদ পরিত্রাণ পাওয়া আত্মাদের সঙ্গীদের সাথে মিলিত হবে না’। সেইন্ট থমাস অ্যাকোয়াইনাস অবশ্যই এর সাথে একমত হতেন না।
হোয়াইটের এই ‘নরক’ বিলোপের ধারণাটি পছন্দ করেছিলেন ঊনবিংশ শতকের আরেকজন আমেরিকান, যিনি এই পৃথিবীর কখন পরিসমাপ্তি হবে সেটি অনুসন্ধান করছিলেন। চার্লস টেজ রাসেল ছিলেন পিটসবার্গের একজন দোকানি, উইলিয়াম মিলারের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো যাকে খুব প্রভাবিত করেছিল। তবে মিলারের ব্যতিক্রম, তিনি সেই মহা-আশাভঙ্গের হতাশার কাছে পরাজয় স্বীকার করেননি যখন যিশুর প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি তাদের ধারণামতো ঘটেনি। তিনি এই সমস্যাটির সমাধান করেছিলেন এই বলে যে, যিশু আসলে ফিরে এসেছেন, তবে তিনি তার উপস্থিতি লুকিয়ে রেখেছেন অদৃশ্য একটি চাদরের আড়ালে। সুতরাং এই দিনগুলোই ‘ছিল’ শেষদিন এবং সেই ‘এন্ড টাইম বা শেষ সময় আসলেই ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এটি দৃশ্যগতভাবে এর চরম শিখরে উঠবে ১৯১৪ সালে আরমাগেডনের শেষ যুদ্ধের সময়।
স্কটিশ-সংস্কারক জন নক্সের মতো, রাসেলও ওল্ড টেস্টামেন্টের নবী ডানিয়েলকে নিউ টেস্টামেন্টের নবী জনের সাথে এক করে ফেলেছিলেন, যিনি বুক অব রিভিলেশন লিখেছিলেন। জনকে আইলে অব পাটমসে নির্বাসিত করা হয়েছিল যখন রোমসম্রাট ডমিসিয়ান চার্চ এবং খিস্টানদের উপর তার নির্যাতনপর্বটি শুরু করেছিলেন। এভাবে বইটি শুরু হয়েছিল, যিশুখ্রিস্টের কাছে আসা ঐশী প্রত্যাদেশ, যা ঈশ্বর তাকে জানিয়েছিলেন, সেইসব কিছু তার ভৃত্যদের প্রদর্শন করতে, খুব শীঘ্রই যা শেষ হতে যাচ্ছে…’। জন এরপর আমাদের বলেন, তিনি একধরনের ধ্যানে নিমগ্ন ছিলেন লর্ডস ডে’ বা রোববারে এবং তিনি একটি কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলেন, ‘দেখো, একজন চোর হিসাবে আমি এসেছি। সেই ব্যক্তি আশীর্বাদপুষ্ট, যিনি সতর্ক নজর রাখেন…’। এই কণ্ঠটি ঘোষণা করেছিল যে, শেষ যুদ্ধটি সংঘটিত হবে এমন একটি জায়গায় হিব্রুভাষায় যে-জায়গাটির নাম আর্মাগেডন’। জেরুজালেমের উত্তরে একটি মাঠের নাম ছিল আমাগেডন, এবং ইজরায়েলের ইতিহাসে বেশকিছু যুদ্ধ এখানে সংঘটিত হয়েছিল।
এটুকুই রাসেলের জন্য যথেষ্ট ছিল। ১৮৭৯ সালে তিনি একটি নতুন ধর্মীয় আন্দোলনের সূচনা করেন, যার নাম ছিল দ্য ওয়াচটাওয়ার, সেইসব অনুসারীদের জন্যে যারা যিশুর দ্বিতীয় আগমন ও এর পরে আসা আর্মাগেডনের ব্যাপারে সতর্ক নজর রেখেছেন। ভবিষ্যতে কী আসছে সেই বিষয়ে তাদের পক্ষে যতটা সম্ভব তত সংখ্যক মানুষকে তারা সতর্ক করতে চান। যদিও তাদের হিসাব অনুযায়ী শুধুমাত্র ১৪৪,০০০ জন মানুষ এর থেকে পরিত্রাণ পাবেন। বাকি সবাই, যেমন, এলেন হোয়াইট ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হবার জন্যে নিয়তি-নির্দিষ্ট। রাসেল অ্যাডভেন্টিস্টদের থেকে অনেক কিছু গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু তার এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় তিনি খুবই বাছবিচার করেছিলেন। নরকের ধারণাটি বাদ দিতে পেরে তিনি খুশি হয়েছিলেন, তবে তিনি আরো কিছু বাদ দিতে চেয়েছিলেন। ট্রিনিটির ধারণাটি বাদ দিতে হবে, ঈশ্বর বা জিহোভা, তাকে যে নামে ডাকতে তিনি পছন্দ করতেন, শুধুমাত্র তাকেই তার দরকার।