এই পুরো বইটিতে আমরা দেখেছি, কোনো একটি নতুন ধর্মীয় আন্দোলন সূচনা করা আপনার স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর প্রমাণিত হতে পারে। কারণ মানুষ পছন্দ করে না কেউ তাদের বলুক যে, তাদের ধর্ম ভুল। যিশু নিজেই বলেছিলেন, তাদের নিজের মানুষের কাছে ছাড়া নবীরা অসম্মানিত ব্যক্তি নন। বিশ্বাস করা বেশ কঠিন হয়ে ওঠে, যখন এমন কেউ, যাকে কিনা আপনি সারাজীবন ধরেই চেনেন, তাকেই একজন নবী হবার জন্যেই ঈশ্বর নির্বাচিত করেছেন। আর জোসেফ স্মিথ এই নিয়মের ব্যতিক্রম ছিলেন না। কী ভেবেছেন তিনি নিজেকে? তার এমন দাবি শুনে অন্য চার্চ-নেতারা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তাকে ও তার অনুসারীদের কারাবন্দি করা হয়েছিল, আটক করার জন্যে প্রতিটি শহরে তাদের খোঁজা শুরু হয়েছিল। কিন্তু ঐশী প্রত্যাদেশ আসা অব্যাহত ছিল এবং আরো বই যুক্ত হয়েছিল মর্মন ধর্মশাস্ত্রের বইয়ের তাকে। তবে অন্য খ্রিস্টানদের চোখে যে-বিষয়টি তার। সুনাম পুরোপুরি ধ্বংস করেছিল সেটি হচ্ছে যৌনতা। কোনো ফেরেশতা আপনাকে নতুন একটি বাইবেলের তথ্য উন্মোচন করেছে এমন কিছু বলা এক কথা, কিন্তু খুবই ভিন্ন এমন কিছু বলা, ফেরশতা আপনাকে অন্য ব্যক্তিদের স্ত্রীদের গ্রহণ। করতে বলেছে।
স্মিথকে তার ফেরেশতা বলেছিলেন, ‘চার্চ অব দ্য ল্যাটার ডে সেইন্ট’ প্রাচীন ইজরায়েলের সত্যিকারের ধর্মবিশ্বাসটিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে। আর যেহেতু আব্রাহাম এবং অন্য গোত্রপিতাদের একাধিক স্ত্রী ছিলেন, তাকে অবশ্যই সেই উদাহরণ অনুসরণ করতে হবে এবং বাইবেল বর্ণিত বহু-বিবাহপ্রথা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা পুরুষদেরকে একই সাথে একাধিক স্ত্রীকে বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছে। স্মিথ সেই নির্দেশটি মান্য করেছিলেন এবং চল্লিশজন স্ত্রী তিনি সংগ্রহ। করেছিলেন, যাদের মধ্যে কয়েকজন ইতিমধ্যেই তারই চার্চের অন্য পুরুষদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। আর তার বিরোধীদের সহ্যের সীমা অতিক্রম করার জন্যে এটাই যথেষ্ট ছিল। আমেরিকার পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোয় নির্যাতন এড়াতে স্মিথ তার অনুসারীদের নিয়ে পশ্চিমে ওহাইও এবং ইলিনোয়া রাজ্যে এসেছিলেন, যেখানে ১৮৩৬ সালে প্রথম মর্মন টেম্পল নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু তার পেছনে লেগে-থাকা মানুষগুলো থেকে পালিয়ে বেড়ানো তার জন্যে খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল। অবশেষে ১৮৪৪ সালে, ইলিনোয়ার কার্থেজে তার নিয়মিত একটি কারাবাসের সময় তাকে ও তার ভাই হাইরুম স্মিথকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু যে চার্চ তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এটি তা আদৌ দমিয়ে রাখতে পারেনি। শহীদের রক্ত সবসময়ই চার্চের বীজ হিসাবে কাজ করে। ১৮৪৭ সালে মর্মনরা ব্রিগহাম ইয়ংকে তাদের নতুন নেতা নির্বাচিত করেছিল। যদি মর্মনদের নবী হয়ে থাকেন স্মিথ, তাহলে ইয়ং হচ্ছেন এটিকে এর শক্তিশালী রূপ দেওয়া একজন সংগঠক, যে-মানুষটি এমন একটি কাঠামো তৈরি করেছিলেন, যা এই ধর্মটিকে একটি স্থায়ী জীবন দিয়েছিল।
ইয়ং ১৮০১ সালে ভারমন্টে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এগারো সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন নবম। তিনি ছিলেন সেইসব মেধাবী প্রায়োগিক-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের একজন, যারা যে-কোনো কাজেই তাদের দক্ষতা প্রদর্শন করতে সক্ষম। ১৮৩২ সালে যখন তিনি চার্চ অব জিসাস ক্রাইস্ট অব দ্য ল্যাটার-ডে সেইন্টের সদস্য হিসাবে দীক্ষিত হয়েছিলেন, তিনি তার সমীহজাগানো সেই প্রতিভাটিকে ব্যয় করেছিলেন এই নতুন আন্দোলনের কল্যাণে। মর্মন চার্চ সংস্কার করার প্রক্রিয়ায় স্মিথ বারোজন সদস্যের শক্তিশালী একটি পরিচালনা কমিটি সৃষ্টি করেছিলেন, ‘গ্রুপ অব টুয়েলভ অ্যাপোস্টলস’ নামে যারা পরিচিত। ১৮৩৫ সালে একজন অ্যাপোস্টল হিসাবে ইয়ং দীক্ষিত হয়েছিলেন। তার যোগ্যতা লক্ষ করে স্মিথ তাকে চার্চের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডগুলো পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। একটি বিস্ময়কর এবং অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে মর্মনবাদ একেবারে প্রথম থেকেই পার্থিব এবং বৈষয়িক নানা কর্মকাণ্ড ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে খুব দৃঢ়ভাবেই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিল।
স্মিথের হত্যাকাণ্ডের পর যখন তিনি মর্মন চার্চের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, ইয়ংকে প্রথম যে-চ্যালেঞ্জটি মোকাবেলা করতে হয়েছিল, সেটি হচ্ছে চার্চের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আর তার সমাধান ছিল এটিকে আরো পশ্চিমে, ইউটাহ রাজ্যের দিকে নিয়ে যাওয়া, যে-রাজ্যটি তখন মেক্সিকোর নিয়ন্ত্রণে ছিল। ইউটাহ হয়তো মর্মনদের প্রতিশ্রুত দেশ হতে পারে, কিন্তু সেখানে ইতিমধ্যেই বাস করতেন ‘উটে’ ইন্ডিয়ানরা। শুরুতে এটি অবশ্য স্মিথকে ভাবায়নি। বুক অব মর্মন তাকে জানিয়েছিল আদিবাসী এই ইন্ডিয়ানরাও ইজরায়েলাইটদের বংশধর, যারা খ্রিস্টের জন্মের বহুশত বছর আগে আমেরিকায় এসেছিলেন। সুতরাং উটেরা সেই মানুষদের উত্তরসূরি, যাদের প্রতি ধর্ম প্রচার করেছিলেন যিশু, জেরুজালেমে তার মৃত্যুর পরে পুনরুজ্জীবিত হবার পর তিনি এখানে বেড়াতে এসেছিলেন। এর মানে হচ্ছে যে, অন্য কোনো বসতিস্থাপনকারীদের মতো যারা আমেরিকার পশ্চিমে আগ্রাসন করে দখল করেছিল, মর্মনরা তাদের সাথে সাক্ষাৎ হওয়া আদিবাসীদের প্রতি কোনো সহিংস আচরণ করেনি। কারণ তারা ইতিমধ্যেই তাদের ধর্মীয় ইতিহাসের অংশ ছিল। তাদের ধর্মান্তরিত করা তাদের পরিকল্পনায় ছিল, তারা যিশুর সেই মিশনটি শেষ করতে চেয়েছিলেন, যা তিনি আঠারোশত বছর আগে সূচনা করেছিলেন।