আমার সম্বন্ধে তারা কিছুই জানেন না, কিন্তু আমি তাদের সম্বন্ধে বেশকিছু জানি। আমি জানি যে, তারা মর্মন, চার্চ অব জেসাস ক্রাইস্ট অব দ্য ল্যাটার-ডে সেইন্ট থেকে এদেশে এসেছেন। আমি জানি তাদের মূল দপ্তরটি যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলের একটি রাজ্য, ইউটাহ’র সল্ট লেক সিটিতে অবস্থিত। আর আমি জানি এই চার্চের প্রতিটি পুরুষ-সদস্যকে বাধ্যতমূলকভাবে দেশে অথবা বিদেশে দুই বছর মিশনারি হিসাবে তাদের চার্চকে সেবা দিতে হয়। আর সে-কারণে আমি এই তরুণদের সাথে দ্র ব্যবহার করি, যারা আমাকে ধর্মান্তরিত করতে চেষ্টা করে। নিজ দেশ থেকে এখন বহুদূরে, বেশ শীতল একটি আবহাওয়ায় তাদের কাজ করতে হচ্ছে, এমন একটি দেশে যে-দেশটি সম্বন্ধে খুব সামান্যই তারা জানেন, আর চেষ্টা করছেন আমাকে প্ররোচিত করতে, যেন আমি বিশ্বাস করি যে যিশুখ্রিস্ট ফিরে এসেছেন। অবশ্যই এর আগেও আমি এমন কথা শুনেছি, কিন্তু তারা যেভাবে বলে থাকেন, সেভাবে নয়। তারা আমাকে জানাচ্ছেন যে, এরপর। যখন যিশু আবার পৃথিবীতে ফিরে আসবেন, তিনি জেরুজালেম নয়, বরং আমেরিকায় আসবেন। এবং এটাই তার প্রথম আমেরিকা ভ্রমণ নয়, এর আগেও তিনি সেখানে গিয়েছিলেন।
কীভাবে তারা সেটি জানতে পারলেন? কোথায় তারা এই তথ্যটি পেয়েছেন? তারা এই তথ্যটি ঠিক সেভাবেই পেয়েছিলেন, যেভাবে সব ধর্মীয় ধারণা সাধারণত পৃথিবীতে প্রবেশ করে থাকে। একজন নবীর কাছ থেকে, যিনি কোনো দৈবদৃশ্য বা কণ্ঠের নির্দেশ শুনেছিলেন এবং তিনি লিখে রেখেছিলেন যা সেই ঐশী উৎস থেকে তার কাছে উন্মোচিত করা হয়েছিল। এবং তিনি অন্যদের সেটি বিশ্বাস করার জন্যে প্ররোচিত করেছিলেন। এই নবী ছিলেন একজন আমেরিকাবাসী। তার নাম ছিল জোসেফ স্মিথ। তিনি ভারমন্টের শ্যারনে একটি সাধারণ কৃষক-পরিবারে ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, পরিবারটি পরে নিউইয়র্কের উত্তরাঞ্চলে স্থায়ী হয়েছিল। শৈশব থেকেই নিজের শহরের প্রটেস্টান্ট চার্চগুলোর মধ্যে বিভাজন আর পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখে তিনি বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কীভাবে তিনি এদের মধ্য থেকে একটি বেছে নেবেন?
তার আগে আসা নবীদের মতো এই সমস্যাটি নিয়ে প্রার্থনা করতে তিনি সবকিছু থেকে দূরে চলে গিয়েছিলেন এবং এই প্রার্থনা করার সময় তিনি একটি দৈব্যদৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। একজন ফেরেশতা তাকে স্থানীয় সব চার্চ এড়িয়ে চলতে উপদেশ দিয়েছিলেন। এর কারণ হিসাবে তিনি তাকে বলেছিলেন, তারা যিশুর শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হয়েছে। প্রথম অ্যাপোস্টলের মৃত্যুর পর থেকে দূষিত ধারণাগুলো খ্রিস্টধর্মে প্রবেশ করেছে এবং এটি দিভ্রষ্ট হয়েছে। কিন্তু এটি আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে, আর তিনি হবেন এই পরিবর্তনের নিয়ামক। তার উচিত হবে নিজেকে প্রস্তুত রাখা। উপযুক্ত সময় হলে তিনি চার্চকে এর মূল বিশুদ্ধরূপে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবেন এবং আবারো এটিকে সত্যপথে চলার নির্দেশনা দেবেন।
সুতরাং তিনি অপেক্ষা করেছিলেন। এবং যখন তার বয়স পঁচিশ, সেই আমূল–পরিবর্তনকারী ঐশী নির্দেশটি এসেছিল। একজন ফেরেশতা প্রাচীন আমেরিকার নবীদের লেখা একটি সংকলনের অস্তিত্বের কথা তাকে জানিয়েছিলেন। চতুর্থ শতাব্দীর কোনো একটি সময়ে সোনার ফলকের উপর একটি বই খোদাই করে লেখা হয়েছিল, আর নিউইয়র্কে পালমিরায় একটি পাহাড়ে সেগুলোকে মাটির নিচে লুকিয়ে রেখেছিলেন মর্মন নামের একজন ব্যক্তি। এগুলোর বিষয়বস্তু এমনকি খ্রিস্টের জন্মেরও কয়েক শতাব্দী প্রাচীন। এটি মধ্যপ্রাচ্যে নেফাইট এবং অন্য গোত্রদের কথা বলেছিল, যারা প্রাচীনে সেই অতীতে আমেরিকায় পালিয়ে এসেছিলেন। আর যে ফেরেশতা এই তথ্যগুলো জোসেফ স্মিথকে জানিয়েছিলেন তার নাম ছিল মরোনি। পরে স্মিথ আবিষ্কার করেছিলেন, মরোনির কথাও সেই বইয়ে আছে, যার অস্তিত্ব তিনি তাকে জানিয়েছিলেন। একটি যুদ্ধে মারা যাবার পর মরোনিকে পুনর্জীবিত করে ফেরেশতার মর্যাদা দান করা হয়। আর এই ফেরেশতা হিসাবে তার দায়িত্ব পালনকালে তিনি স্মিথকে বুক অব মর্মনের সোনালি প্লেটগুলোর অস্তিত্বের কথা জানিয়েছিলেন।
দাবি করা হয়ে থাকে, চার বছর পরে স্মিম এই প্লেটগুলো মাটির নিচ থেকে খনন করে বের করেছিলেন এবং তিনি সেগুলো ইংরেজি অনুবাদ করতে শুরু করেন। তিন মাস ধরে তিনি প্রায় পাঁচশো পাতার একটি বই লিখেছিলেন, যা বুক অব মর্মন’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল। বলা হয় তার অনুবাদ করা মূল বইটি সংকলিত হয়েছিল ৩১১ থেকে ৩৮৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী কোনো সময়ে এবং এটি পড়তে এর প্রায় বারোশো বছর পরে আরেকটি বিখ্যাত অনুবাদের মতোই অনুভূত হয়, সেটি হচ্ছে ১৬১১ সালে সংকলিত ‘কিং জেমস বাইবেল’, প্রটেস্টান্ট চার্চগুলোর প্রিয় একটি সংস্করণ, এবং যার সাথে স্মিথের পরিচিতি থাকার সম্ভাবনা খুব বেশি। ‘বুক অব মর্মন’ থেকে এই অংশগুলো এর মেজাজ কেমন জানান দিচ্ছে:
কারণ এটিও একদিন অতিক্রান্ত হবে, বলেছেন তোমার পিতা, এবং সেই দিনে যারা অনুতপ্ত হবে না এবং আমার প্রিয় পুত্রের অনুসারী হবে না, আমি তাদের তোমার জনগোষ্ঠী থেকে পৃথক করে ফেলব, ও ইজরায়েলবাসীরা। আমি তাদের উপর প্রতিশোধ নেব এবং ক্রোধ বর্ষণ করব, একই সাথে সেই বিধর্মীদের উপরেও, যারা এই বার্তা পায়নি।
বুক অব মর্মন অন্যান্য অ্যাপোক্যালিপটিক বা মহাপ্রলয়বাদী বইগুলোর মধ্যে একটি, যা যিশুখ্রিস্টের প্রত্যাবর্তন আর সবকিছু তার শাসনের অধীনে নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছিল। তবে পার্থক্যটি হচ্ছে এবার ‘নিউ জাইওন’ প্রতিষ্ঠিত হবে আমেরিকায়। কোনো বিস্ময় নেই সেখানে, যখন বুক অব মর্মন থেকে আমরা জানতে পারি, ঈশ্বর মধ্যপ্রাচ্য থেকে তার পরিকল্পনা আমেরিকার পশ্চিমে পরিবর্তন করেছেন। এবং নতুন ‘হলি ল্যান্ড’ বা পবিত্রভূমি হিসাবে আমেরিকার মর্যাদা নিশ্চিত করতে যিশু নিজেই ৩৪ খ্রিস্টাব্দে তার পুনরুত্থানের কয়েক মাস পরে এই মহাদেশে স্বয়ং এসেছিলেন। এই বইটি বলছে যে, যিশুখ্রিস্ট নেফাই জনগোষ্ঠীর কাছে তার দর্শন দিয়েছিলেন, যারা বহুসংখ্যায় একত্র হয়েছিলেন এই সমৃদ্ধ দেশে এবং তাদের উদ্দেশ্যে তিনি ধর্ম প্রচার করেছিলেন…’। এই সবই খুবই শক্তিশালী প্রস্তাবনা ছিল। আর এই বার্তাটি বিশ্বকে জানাতে হবে। সুতরাং ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল, জোসেফ স্মিথ নিউইয়র্কের ফ্যায়েটে তার গসপেল (সুসংবাদ) প্রচার করতে শুরু করেছিলেন। তিনি তার এই আন্দোলনকে একটি নতুন চার্চ হিসাবে নয় বরং প্রাচীন চার্চের একটি শুদ্ধিকরণ হিসাবে দেখেছিলেন। প্রথম খ্রিস্টধর্মীয়রা। নিজেদের সেইন্ট বলে ডাকতেন। এর সদস্যরাও সেইন্ট, আজকের সেইন্ট। সুতরাং চার্চ অব জিসাস ক্রাইস্ট অব ল্যাটার-ডে সেইন্টসদের জন্ম হয়েছিল। এবং বুক অব মর্মন ছিল এর বাইবেল।