পরবর্তী অধ্যায়ে এইসব সুনির্দিষ্ট হিন্দুশিক্ষাগুলোর কয়েকটির আবির্ভাব কীভাবে হয়েছিল আর যেভাবে সেগুলো ব্যাখ্যা করা হয়েছে, সেটি আমরা অনুসন্ধান করব। কিন্তু আমি ধর্মের আরেকটি বড় প্রশ্নের হিন্দুধর্মীয় উত্তরটি দিয়ে এই অধ্যায়টি শেষ করতে চাই। মৃত্যুর পর আমাদের সাথে কী ঘটে সেই প্রশ্নটির উত্তর এই ধর্মটি কীভাবে দিয়েছে ইতিমধ্যেই সেটি আমরা দেখেছি। উপনিষদের উত্তরটি ছিল পুনর্জন্মবাদের আকর্ষণীয় মতবাদ। আরেকটি যে-প্রশ্ন ধর্ম সবসময়ই জিজ্ঞাসা করে থাকে, সেটি হচ্ছে : যদি কিছু থেকে থাকে, তাহলে এই মহাবিশ্বের সীমানা পেরিয়ে সেই অসীম অন্ধকারে আসলে কী আছে? অন্য ধর্মগুলো মূলত নবীদের নাম উল্লেখ করেছে, যারা তাদের এই উত্তরগুলো দিয়ে গেছেন, এবং তাদের উত্তরগুলোকে তারা নিজেদের উত্তর হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছেন। তাদের নামেই তারা নিজেদের ও তাদের ধর্মের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু হিন্দুধর্মের সাথে
এমনটা ঘটেনি। এই ধর্মে এমন কোনো প্রতিষ্ঠাতা নেই, যার কাছ থেকে ধর্মটি। তার নাম নিতে পারে। অতীতেও একক কোনো চরিত্র নেই, যার কাছ থেকে এটি অনুপ্রেরণা পেয়েছে বলে দাবি করতে পারে। ভারতের গভীর অতীতের অজ্ঞাতনামা কিছু স্বাপ্নিকদের কাছ থেকে এটি এসেছিল। কিন্তু যদিও ঐসব প্রাচীন স্বাপ্নিকদের নাম তারা মনে রাখেননি ঠিকই, তবে তাদের যা-কিছু বলা হয়েছিল, সেটি তারা সংরক্ষণ করেছেন।
এবং ঋগ্বেদে এটি ধর্মের সেই প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া শুরু করেছিল, আসলেই আমাদের এই মহাবিশ্বের বাইরে কী আছে। আর এটি শুনতে হলে সেই উত্তর ভারতের নক্ষত্রপূর্ণ আকাশের নিচে আগুনের পাশে বসে আছেন এমন একটি দৃশ্য কল্পনা করতে হবে, যেখানে তাদের অজানা সাধুদের একজন সময়কে ভেদ করে মহাবিশ্বের সেই সূচনা আর সেটিকে ছাড়িয়ে যেতেন। কথা নয়, রাতের অন্ধকারের দিকে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে তিনি স্তব পাঠ করতেন :
যখন অনস্তিত্ব কিংবা অস্তিত্ব কিছুই ছিল না: কোনো বায়ুর
জগৎ ছিল না, সেটি ছাড়িয়ে ছিল না কোনো আকাশ;
সেই ‘একটি’ মাত্র জিনিস, কোনো নিশ্বাস ছাড়া,
তার নিজের প্রকৃতি দিয়ে শ্বাস নিয়েছিল :
এটি ছাড়া আর কোনোকিছুই ছিল না।
এই পৃথিবী তৈরি হবার পরেই দেবতাদের সৃষ্টি হয়েছে।
কে তাহলে জানে।
কীভাবে এটি প্রথম অস্তিত্বশীল হয়ে উঠেছিল?
তিনি, এইসব সৃষ্টির যিনি প্রথম, তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছিলেন,
অথবা করেননি।
যার চোখ নিয়ন্ত্রণ করে সর্বোচ্চ আকাশ,
আসলেই তিনি সবকিছুই জানেন,
অথবা হয়তো তিনি সেটি জানেন না।
তিনি যে স্তবটি পাঠ করছেন আর আমরা শুনছি, সেখানে বিস্ময় আছে। আমাদের বলা হয়েছে, দেবতারা আছে, কিন্তু তাদের সৃষ্টি হয়েছে এই মহাবিশ্ব সৃষ্টির পরে। এর মানে হচ্ছে তারাও, আমাদের মতোই সৃষ্ট এবং তারা সময়ের সেই চক্রের ঘূর্ণনে আবদ্ধ। তারাও আমাদের মতোই আসেন এবং চলে যান। কিন্তু সেই স্বাপ্নিক আভাস দিয়েছেন, ঐসব রূপ-পরিবর্তনের পেছনে এমন কিছু আছে যা কখনোই বদলায় না, অপরিবর্তনশীল; সেই একটা জিনিস, যেভাবে তিনি বলেছেন। যেন ইতিহাস আর এর পাত্রপাত্রীরা সব কুয়াশার মতো কিছু, যা বিশাল কোনো পর্বতের উপস্থিতিকেও আচ্ছাদিত আর বিকৃত করে উপস্থাপন করতে পারে : ‘সেই একটি জিনিস’, কিন্তু কী সেটা? আর দেবতারাই বা কে, যারা এর প্রতিনিধিঃ
০৪. এক থেকে অনেক
একদিন শুনতে পেলেন, আপনার প্রিয় লেখক আপনার শহরে আসছেন তার কাজ নিয়ে কথা বলতে। আপনি সেই বইয়ের দোকানে গেলেন, যেখানে তিনি তার বক্তব্য দেবেন, এবং নতুন বই থেকে কিছু অংশ তিনি পাঠ করে শোনালেন, আপনার কাছে দীর্ঘদিন ধরেই পরিচিত চরিত্রগুলোর সাম্প্রতিক নানা অভিযানের কাহিনি। আপনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথা থেকে এইসব চরিত্রগুলো এসেছে। কোথাও কি আসলেই তাদের অস্তিত্ব আছে? তিনি হাসলেন এবং বললেন, শুধুমাত্র আমার কল্পনায়। এই সবকিছুই তার মনগড়া। তারা সবাই এসেছে তার মস্তিষ্ক থেকে। সুতরাং তিনি তাদেরকে দিয়ে তার ইচ্ছামতো যে-কোনো কিছুই করাতে পারেন।
কী হতে পারে যদি বাসায় ফেরার পথে আপনার নিজেরই হঠাৎ করে মনে হয়, হয়তো আপনিও তাদের মতো বাস্তব কোনো চরিত্র না? আর আপনি হয়তো অন্য কোনো একজনের সৃষ্টি, কারো কল্পনা-সৃষ্ট প্লটের একটি চরিত্র?। যদি এমন কিছু ঘটে, তাহলে সেটি হবে যেন কোনো একটি বইয়ের চরিত্র অনুধাবন করতে পেরেছে যে, আসলে তার স্বাধীন কোনো জীবন নেই, তিনি শুধুমাত্র কোনো একজন লেখকের কল্পনার সৃষ্টি।
এটি সেই ধারণাটির মতো যা ভারতের সাধুদের কোনো ঐশী প্রত্যাদেশের শক্তিতে আঘাত করেছিল। তারা নিজেরাই আসলে বাস্তব নয়। শুধুমাত্র একটি জিনিসই চূড়ান্তভাবে বাস্তব : বিশ্বজনীন আত্মা অথবা স্পিরিট, যার নাম তারা দিয়েছিলেন ‘ব্রহ্ম’ (ব্রহ্ম), যা এরা নিজেকেই বহুরূপে প্রকাশ ও সৃষ্টি করেছিল। এই পৃথিবীতে সত্যিকার বাস্তবতায় যা-কিছুর অস্তিত্ব আছে, সেগুলো বাস্ত বিকভাবেই ব্ৰহ্মনের বহু ছদ্মবেশ আর রূপের একটি দিক মাত্র। যেমন, উপনিষদ বলেছে, সবকিছুর মধ্যেই এটি লুকিয়ে আছে, সব সত্তার মধ্যে সেই নিজস্ব স্বরূপ–যা সব সৃষ্টি আর কর্মের ওপর তদারকি করছে, যা সব সত্তার ভিতরে বাস করছে, সাক্ষী, পর্যবেক্ষণকারী, শুধুমাত্র একটি ‘সত্তা’। এবং তারা যেমন ব্রহ্মনের অংশ, ব্রহ্মও তাদের অংশ।