এলি ম্যারিয়ন তাকালেন তার কনফারেন্স রুমের কুড়ি মিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যমানের পেইন্টিংস, টেবিল, চেয়ার, সোফা, ক্রিস্টালের ওয়াইনপূর্ণ ধারক আরো মর্গগুলোর দিকে। তার এই দৃষ্টি ছিল উদাসীন। এসব যেন তারই শরীরের খণ্ড খণ্ড টুকরো। ম্যারিয়নের মনে হলো, যেন শরীরের টুকরোগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে।
এলি ম্যারিয়ন নিজেই অবাক হয়ে ভাবেন কতটা কৌশলের সাথে তিনি নিজেকে একজন শক্তিশালী, প্রভাবশালী হিসেবে সারা বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করে থাকেন। খুব কঠিন মনে হয় তার বিশ্বের অপর পাওয়ারফুল ব্যক্তিদের সাথে তাল মিলিয়ে চলা।
ম্যারিয়নের সকালগুলো কখনোই পুরোপুরি অবসাদমুক্ত হওয়ার সুযোগ পায় না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয় তাকে। ক্লান্তিভরা শরীর নিয়ে শেভ করেন, কোটের বোম লাগান একে একে। তারপর বাঁধেন টাই–টাইয়ের নটটা সামলাতেও বেগ পেতে হয় তার। তবে মনের জোরেই করতে থাকেন সবকিছু। তিনি জানেন মানুষের মানসিক দুর্বলতা হচ্ছে সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয়। এটা সক্রিয় হলে যে কোনো মানুষ তার জীবনের ছন্দ হারিয়ে ফেলবে, ক্ষমতাহীন হয়ে পড়বে। তবে এ বয়সে ম্যারিয়ন আর কত দিন তার মনের জোর ধরে রাখবেন?
তিনি এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ববি বানজকে ব্যবহার করছেন। তার কাছে ধীরে ধীরে গছিয়ে দিচ্ছেন ক্ষমতা। বানজ প্রায় তিরিশ বছরের ছোট হলেও তাকে বন্ধুসুলভ দৃষ্টিতেই দেখেন ম্যারিয়ন। সবচেয়ে কাছের বন্ধু মনে করেন তাকে। এর কারণ দীর্ঘ সময় ধরে বানজ ম্যারিয়নের আনুগত্য।
স্টুডিওর প্রেসিডেন্ট এবং চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসারের দায়িত্বে রয়েছে বানজ। প্রায় তিরিশ বছর যাবৎ বানজ যেন ম্যারিয়নের কুড়াল। এই দীর্ঘ সময় ধরে তাদের সম্পর্কে একটি নতুন মাত্রাও যোগ হয়েছে। সেটি পিতা-পুত্রের অনেকেই এমন মন্তব্য করে থাকেন আজকাল। ম্যারিয়নের সত্তর বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর থেকে, ক্রমেই তিনি স্বভাবগত কোমল হতে থাকেন। ঠিক ততটুকুই করেন যতটুকু না করলেই নয়। তবে বানজ এক্ষেত্রে সদা সক্রিয়।
বানজ ছিল এক সময় ছবির পরিচালক। সেই পরিচালক থেকে ম্যারিয়ন তাকে তুলে এনেছেন সমগোত্রে। ম্যারিয়নের সাথে যৌথ ছবি নির্মাণ করে দর্শকের জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর থেকেই উভয়ের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটতে থাকে। বানজ লডস্টোন স্টুডিওর একটি নিন্দনীয় নাম। এই সেই বানজ, যে ছবির পরিচালক, স্টার ও লেখকদের পারিশ্রমিক প্রদানে ঠকিয়ে যাচ্ছে অনবরত। কেউ বিদ্রোহ করে উঠলে আদালতের আশ্রয় নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। এই সেই বানজ যে যে কোনো ট্যালেন্টকে কঠিন শর্তে চুক্তিবদ্ধ করতে বাধ্য করে। এটি ঘটে বিশেষ করে লেখকদের ক্ষেত্রে।
লেখকদের একটি সাধারণ মাত্রার সম্মানী দিতেও তার কার্পণ্যের সীমা নেই। অনেক ক্ষেত্রে লেখকদের স্ক্রিপ্ট তার হাতে যাওয়ার পরপরই অস্বীকারও করে বসে। তবে বানজের কাছে মোটামুটি একটা মূল্য পায় পরিচালক। পরিচালকের গুরুত্ব তার কাছে একটু বেশিই। এর কারণ তারা হচ্ছে ছবির কলকাঠি নাড়নেঅলা–ইচ্ছে করলেই অন্ধ বানিয়ে ফেলতে পারে তারা। প্রযোজকদের ক্ষেত্রেও বানজের মনোভাব কিছুটা নমনীয়। চুরিবৃত্তির গলদ না পাওয়া পর্যন্ত বানজের কাছে প্রযোজকরা হচ্ছে ছবি তৈরির মানসিক শক্তির উৎস।
কিন্তু লেখকরা? বেচারা লেখকদের চুক্তিবদ্ধ হতে হয় বানজের কাছে শূন্য সাদা কাগজে। এতে সায় না থাকলে এমন অনেক লেখক বের করে নেয়া যায় বলে একটা হুমকিও শোনা যাবে তার মুখে। লেখা নির্বাচিত হওয়ার পর প্রযোজক বিভিন্ন দৃশ্যের জন্য প্লট সাজান। পরিচালক দেন তার বাণিজ্যিক ভিত্তি এবং স্টাররা সংলাপের অভিব্যক্তিতে ফুটিয়ে তুলতে থাকেন দৃশ্যের পর দৃশ্য। কোনো কারণে কোনো দৃশ্যে যদি সংলাপ না থাকে তবে সে লেখকের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে বানজ। কেটে নেয়া হবে তার সম্মানীর অংশ। এভাবে পূর্বে বহু লেখককে বঞ্চিত করার ঘটনা ঘটেছে, যা একত্রে করলে কয়েক মিলিয়ন ডলার হতে পারে। তবে লেখকদের ক্ষেত্রে বানজের চেয়ে ম্যারিয়ন অনেকটাই নমনীয়। এর কারণ ছবি নির্মাণে চুক্তিবদ্ধ করাতে স্টার, কলাকুশলীদের চেয়ে লেখকরাই সবচেয়ে সহজ বলে মনে হয় তার।
ম্যারিয়ন এবং বানজ সারা বিশ্বের ফিল্ম ফ্যাস্টিভেলের আয়োজন করে ছবি বিক্রির চেষ্টা চালিয়েছে একসাথে। তাদের ছবির বিশ্ব বাজার তৈরির জন্য তারা কখনো গেছেন লন্ডন, কখনো প্যারিসে, কানসে–কখনোবা টোকিও কিংবা সিঙ্গাপুরে। সারা বিশ্ব সফর করে তাদের কাছে ছবি সংশ্লিষ্ট লেখক, সাধারণ আর্টিস্ট, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ভূমিকাকে একেবারেই নগণ্য মনে হয়েছে। এর পরই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই বঞ্চিতকরণ ধারার। সাম্রাজ্য বিস্তারের নতুন আইন তৈরি হয়েছে তাতে একজন হয়েছেন সম্রাট আর অপরজন তার প্রধান আজ্ঞাবাহী।
এলি ম্যারিয়ন এবং ববি বানজ দুজনে একমতে পৌঁছেছেন। তাদের মনে হয়েছে লেখক, অভিনয় শিল্পী এবং পরিচালক শ্রেণীর লোকরা বিশ্বের সবচেয়ে অকৃতজ্ঞ। বানজ ও ম্যারিয়ন বলে উঠেছেন, আহা এরা যদি একটু সক্রিয় হতো, তাদের ভালো সুযোগের জন্য যদি একটু কৃতজ্ঞ হতো। তারা যদি নিজেদের তুলে ধরতে একটু চেষ্টা করত! একটু বিখ্যাত হলেই তারা কিভাবে যে এত পরিবর্তন করে ফেলে নিজেদের, বোঝা মুশকিল।