অবশ্যই–ক্রস আশ্বস্ত করল তাকে। তারপর বৃদ্ধ গ্রোনিভেল্টকে এই বৈষয়িক প্রসঙ্গ থেকে সরিয়ে আনতে নতুন বিষয়ের উত্থাপন করল।
ক্রস বলল, সেই স্ট্যান্টাডিও যুদ্ধের কাহিনী তুমি আমাকে কখন শোনাবে? আমাকে সে বিষয়ে কখনো কেউ কিছু বলেনি। শুনেছি সে সময় নাকি তুমি তাদের সাথে সান্তাডিও’র কাজ করতে।
বৃদ্ধ গ্লোনিভেন্টের দীর্ঘশ্বাস কেঁপে উঠল। সেই সাথে বিড়বিড় করে তিনি যেন কিছু আওড়ে যাচ্ছিলেন উদাস দৃষ্টিতে। ক্রসের উদ্দেশে বললেন, আমি জানি আমার সময় ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে আমি সেসব ঘটনা তোমাকে শোনাতে পারব না।
একটু দম নিয়ে গ্রোনিভেল্ট আবার বলল, তুমি বরং তোমার বাবার কাছেই শুনে নিও।
ক্রস নাছোড়বান্দার মতো বলল, আমি পিপির কাছে শুনতে চেয়েছি। কিন্তু সেও কেন যেন এড়িয়ে গেছে।
অতীতকে অতীত হিসেবেই রেখে দাও না গ্রোনিভেল্ট প্রতিউত্তরে বলল, কখনো পেছন ফিরে তাকিও না। ক্ষমার জন্যও নয়, নয় বিচারের জন্য কিংবা সুখ খুঁজে পেতে। তুমি এখন যা আছ তা নিয়ে ভাব ভাব এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড নিয়ে।
পেন্থ হাউস কক্ষে ফিরে এলেন গ্রোনিভেল্ট, নার্স তার বিকেলের গোসল পরবর্তী আনুষঙ্গিক কাজ সমাধা করল।
রাতে একটা পরিপূর্ণ ঘুম দিলেন গ্রোনিভেল্ট। খুব ভোরে তার ঘুম ভেঙে গেল। নার্সকে অনুরোধ করলেন তাকে বেলকনি পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার জন্য।
নার্স তাকে একটি বড় চেয়ারে বসিয়ে ব্লাঙ্কেট দিয়ে ঢেকে দিল। পাশে বসে নার্স গ্রোনিভেল্টের পালসও পরখ করে নিল এই ফাঁকে।
নার্সের কোলেই ছিল গ্রোনিভেল্টের হাত। পালস চেক করার পর নার্স যখন তার কোলে ফিরিয়ে দিতে গেল, গ্রোনিভেল্ট অসম্মত হলেন। এক পর্যায়ে নার্স আর বাধা দিল না।
পাশাপাশি দুজন বসেই আকাশে সূর্য উদয়ের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করতে লাগল।
সূর্যের রক্তিম বলয়ের আভা যখন আকাশে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছিল তখন মেঘগুলোর রঙও পাল্টে যাচ্ছিল বিস্ময়করভাবে– কালো-নীলাভ মেঘগুলোতে সূর্যোদয়ের আভা লেগে হয়েছিল গাঢ় কমলা রঙ। ভোরের আকাশে এই রঙের খেলায় মেতে ছিল উভয়ে।
বেলকনি থেকে গ্রোনিভেল্টের দৃষ্টি গেল নিচের ভূ-পৃষ্ঠে। একেবারে আকাশ থেকে নেমে এলেন মাটিতে। দেখতে পেলেন–টেনিস কোর্ট, অদূরে গলফ-এর মাঠ, পাশে সুইমিং পুল, দূরে আবছা ভিলাগুলো যেন থেকে থেকে জ্বলে উঠছিল দূর আকাশের মিটিমিটি তারার মতো।
গ্রোনিভেল্টের দৃষ্টি গেল জানাদু হোটেলে টাঙানো পতাকাগুলোর দিকে। জানাদুর নিজস্ব প্রতীক গাঢ় সবুজের মাঝে সাদা পায়রা সংবলিত ফ্ল্যাগের দিকে তিনি তাকিয়ে থাকলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর তার দৃষ্টি গেল সবশেষে অসীম বালিপূর্ণ সমুদ্র– মরুভূমির দিকে। যেখানে দিগন্তরেখা ভেদ করে একটু আগে উঠেছে আজকের দিনের সূর্য।
বেলকনি থেকে গ্রোনিভেল্টের এই প্রত্যক্ষ অবলোকনে তার মনেও উদিত হয়েছে গর্বের আভা। তিনি ভাবতে লাগলেন– এসবই তার সৃষ্টি। গর্বভরে মনে মনে বলতে লাগলেন, একটি পতিত জমিতে আমিই এনেছি একটি আনন্দের বিনোদনের ভুবন এবং আমি নিজেই আমার সুখী জীবনের স্রষ্টা, বাইরের কেউ নয়।
এই বিশ্বে আমি সর্বদা যথাসাধ্য একজন ভালো মানুষ হিসেবে থাকার চেষ্টা করেছি।
গ্রোনিভেল্ট ফিরে গেলেন তার কিশোর জীবনে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল তার চৌদ্দ বছর বয়স্ক দার্শনিক বন্ধুর কথা। সে বয়সেই তারা আলোচনায় মেতে উঠতেন ঈশ্বর ও তার অস্তিত্বের নৈতিক মূল্যায়নের মতো কঠিন সব বিষয় নিয়ে।
গ্রোনিভেল্টের সেই অন্তরঙ্গ দার্শনিক বন্ধুটি একবার তাকে প্রশ্ন করেছিল, আচ্ছা কেউ যদি তোমাকে এক মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে একটি বাটন পুশ করতে বলে যা করলে দশ লাখ চীনা মারা যাবে, তুমি কি তা করবে? অসম্ভব ও অযাচিত এমন প্রশ্নের অবতারণা করে নিজ থেকেই সে শুরু করত তার নাতিদীর্ঘ বিশ্লেষণ। অবশেষে সে সম্মতিও আদায় করে নিত যে— এমন গর্হিত কাজ অসম্ভব। তবে গ্রোনিভেল্ট তার যুক্তিতে খুব একটা সায় দিতেন না। তিনি হয়তো হত্যাকাণ্ডের পক্ষেই থাকতেন দার্শনিক বন্ধুর সাথে বিতর্কে।
আজ প্রায় পঁচাশি বছর পর জানাদু হোটেলে তার নিজ পেন্থ হাউসের বেলকনিতে বসে ভাবছেন–সে বিতর্কে গ্রোনিভেল্টই ছিলেন সঠিক। এ চিন্তা তার এই সফল জীবনের জন্য নয়–এর কারণ, এমন বিশাল ধরনের একটি হেঁয়ালিপূর্ণ বিতর্ক কোনো কিছুকেই থামিয়ে দিতে যথেষ্ট নয়। এটি দীর্ঘ সময় ধরে উভয় সঙ্কটে ফেলার মতো বিষয়ও নয়।
এখন গ্রোনিভেল্ট বেশ ভালোই বুঝতে পারেন কিশোর কালেও তার সিদ্ধান্তই ছিল সঠিক। দার্শনিক বন্ধুর বিতর্ক থামিয়ে দিয়ে, প্রশ্নটিতে কেন চায় নাম্যানদের হত্যার কথা বলা হলো? আরো এর জন্য দশ লক্ষ ডলারইবা কেন? এই প্রশ্নগুলোই তখন সেই দার্শনিক বন্ধুকে থামিয়ে দিতে প্রতিপ্রশ্ন। এমন চিন্তা গ্রোনিভেল্ট সে বয়সেও করেছেন।
গ্রোনিভেল্ট বাস্তবে ফিরে এলেন। পৃথিবীতে আলোর তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে লাগল। পাশে বসা নার্সকে অনুরোধ করলেন, তিনি তাকালেন সূর্যের প্রখরতার দিকে। চোখে ছানি পড়েছে তার, আর সেটাই তার চোখের বর্ম। নয়তো তিনি যেভাবে সূর্যের দিকে তাকিয়ে ছিলেন সুস্থ চোখ হলে এতক্ষণে ধাধিয়ে যেত।