সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হেগেন। সে জানে, ডনের শিক্ষা হলো, কিছু দিতে হলে সেটাকে ব্যক্তিগত দান হিসেবেই দিতে হয়। ডনের মত একজন। মহাপুরুষ টাকা ধার করে তাকে দান করলেন, এতে অ্যান্টনি কপোলার মর্যাদা এক পলকে কতটা বেড়ে গেল। ডন একজন কোটিপতি, কপোলা তা জানে। কিন্তু গরীব বন্ধুর ছেলেকে সাহায্য করার জন্যে কজন কোটিপতি এ-ধরনের ঝামেলাকে হাসিমুখে নেয়?
মাথা তুলে তাকালেন ডন। দৃষ্টিতে প্রশ্ন।
হেগেন বলল, তালিকায় নাম নেই লুকা, ব্রাসির। কিন্তু তবু একবার দেখা করতে চাইছে সে। প্রকাশ্যে ব্যাপারটা হতে পারে না, এ কথা সে বুঝতেই পারছে না, ব্যক্তিগত ভাবে আপনার সাথে দেখা করে অভিনন্দন জানাবে।
এই প্রথম অপ্রসন্ন দেখাল ডনকে। তবে সরাসরি তিনি আপত্তি প্রকাশ করলেন না। বললেন, কোন দরকার আছে কি?
আপনি তাকে আমার চেয়ে ভাল চেনেন, কাঁধ ঝাঁকাল হেগেন। বিয়েতে দাওয়াত করা হয়েছে, সেজন্যে আশ্চর্য এবং কৃতজ্ঞ বোধ করছে। এতটা আশা করেনি। বোধ হয়…
ইঙ্গিত পেয়ে থেমে গেল হেগেন। লুকা ব্রাসিকে নিয়ে আসতে বলছেন ডন।
বাগানে বসে লুকা ব্রাসির মুখে বুনো একটা হিংস্রতার ছাপ লক্ষ্য করে কে অ্যাডামস তার বিষয়ে কৌতূহল প্রকাশ করছে। কে-কে বিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসার পিছনে মাইকেলের একটা উদ্দেশ্য আছে। ও চাইছে কে একটু একটু করে এবং মোটেও খুব বেশি স্তম্ভিত না হয়ে,ওর বাবার বিষয়ে সব প্রকৃত সত্য যেন জেনে নেয়। কিন্তু, দেখেশুনে ওর মনে হচ্ছে, সামান্য দুর্নীতিপরায়ণ একজন ব্যবসায়ী ছাড়া কে ডন কর্লিয়নিকে আর কিছু ভাবছে না এখনও। মাইকেল ঠিক করল, পরোক্ষ ভাবে ও চেষ্টা করবে আসল ব্যাপারগুলো জানিয়ে দিতে। তাই বুঝিয়ে বলল যে পূবদিকে যত লোক গোপনে আইন লঙ্ঘন করে তাদের মধ্যে লুকা ব্রাসির মত ভয়ঙ্কর, নির্মম পিশাচতুল্য চরিত্র আর একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ওর সবচেয়ে বড় প্রতিভা হলো, কারও সাহায্য না নিয়ে, একাকী, এমন নিখুঁত ভাবে খুন-টুন করতে পারে যে ধরা পড়ার কোন সম্ভাবনা প্রায় থাকেই না। মাইকেল মুখ বিকৃত করল, বলল, এর মধ্যে সত্য মিথ্যা কতটা জানি না। তবে ওর সাথে আমার সম্পর্কটা বন্ধুত্বেরই, বলতে পারো।
এই প্রথম চোখ খুলে গেল কে-র। তার কণ্ঠে অবিশ্বাস, এমন ভয়ঙ্কর লোক ও? তুমি নিশ্চয়ই বলতে চাই না যে এরকম একজন লোককে তোমার বাবা চাকরিতে রেখেছেন?
দুত্তোরি ছাই! ভাবল মাইকেল। সরাসরি বলল, শোনো তাহলে। পনেরো বছর আগের কথা। কয়েকজন লোক বাবার জলপাই তেলের ব্যবসাটা হাত করে। নেবার মতলব এটেছিল। ওদের উদ্দেশ্য ছিল বারাকে খুন করা। খুন প্রায় করে ফেলেছিল। কিন্তু সময় থাকতেই ওদের পিছনে লাগানো হলো ওকে, ওই লুকা ব্রাসিকে। সত্য মিথ্যা জানি না, গুজব হলো, হপ্তা দুয়ের মধ্যে এক এক করে ছয়জনকেই শেষ করেছিল লুকা। বিখ্যাত জলপাই তেল যুদ্ধের সমাপ্তি ওখানেই। হাসল মাইকেল, কথাগুলো যেন কতই না মজার।
শিউরে উঠল মেয়েটা। তোমার বাবাকে খুন করার চেষ্টা করেছিল?
অনেক আগের কথা। পনেরো বছর আগেই সব ঠাণ্ডা মেরে গেছে। ভয় হচ্ছে মাইকেলের, খুব বেশি বলে ফেলেনি তো!
হঠাৎ হাসল কে। মাইকেলের পাজরে মৃদু একটা কনুইয়ের তো মেরে বলল, ভারি চালাক! আসলে আমাকে ভয় দেখাচ্ছ! চাও না যে তোমাকে আমি বিয়ে করি?
আমি চাই তুমি গোটা ব্যাপারটা ভালভাবে ভেবেচিন্তে দেখো, বলল মাইকেল।
ভুরু কুঁচকে কে জানতে চাইল, ছয় জনকে মেরে ফেলেছে, সত্যি?
প্রমাণ হয়নি কিছু। কিন্তু কাগজে তাই লিখেছিল। ওর সম্বন্ধে আরেকটা নাকি গল্প আছে, কিন্তু সেই গল্পের কথা কেউ কাউকে বলে না। সে নাকি সাংঘাতিক একটা ব্যাপার, বাবাও কখনও মুখে আনেন না। মাত্র কয়েকজন জানে গল্পটা, তার মধ্যে টম হেগেন একজন। কিন্তু কিছুতেই বলবে না। একবার শোনার জন্যে জেদ ধরায় সে আমাকে কি বলেছিল, জানো?।
বলেছিল, তোমার বয়স একশো বছর হলে গল্পটা শোনার উপযুক্ত হবে তুমি। নিশ্চয়ই গল্পের মত গল্প! না শুনেই কেমন যেন গা ছমছম করে আমার, শুনলে না জানি কেমন হবে?
লুকা ব্রাসি। নরকের সম্রাট স্বয়ং শয়নও বুঝি এই নাম শুনে আঁতকে ওঠে। বেঁটে, গাঁট্টাগোট্টা, মাথার খুলিটা প্রকাণ্ড, কাছে এলেই বিপদের হিম-শীতল ঢেউ জাগে শরীরে। মুখ নয়, নির্মম হিংস্রতার পুরু মুখোশ যেন। মুখোশের কোথাও প্রাণের সজীবতা থাকে না, ওর মুখেও তা নেই। গায়ের রঙটা কেমন উৎকট বাদামী।
হিংসাত্মক কাজে লুকা ৰাসির সমকক্ষ কেউ নেই, তেমনি ডন কর্লিয়নির প্রতি তার আন্তরিক, অন্ধ ভক্তির ব্যাপারটাও কিংবদন্তীর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ডন কর্লিয়নির বিশাল শক্তিশালী দুর্গের ভিত্তিমূলে গাঁথা প্রকাণ্ড একটা স্তম্ভ এই লুকা ব্রাসি। সারা দুনিয়া খুঁজেও এরকম আরেকটা মানুষ পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।
পুলিশকে ভয় নেই সূকা ব্রাসির, ভয় নেই সমাজকে। সৃষ্টিকর্তাকে ভয় করে না। সে, ভয় করে না নরকযন্ত্রণার সম্ভাবনাকে। মানুষকে? না, মানুষকে সে ভয় করে না, তাকে সে ভালও বাসে না। শুধু একজনকে ছাড়া। স্বেচ্ছায়, যেচে পড়ে, ভালবাসে সে ডন কর্লিয়নিকে, ভয় করে। এইমাত্র নিয়ে আসা হয়েছে ওকে ডন কর্লিয়নির সামনে। ভয়ঙ্কর, হিংস্র মানুষটাকে এখন চেনার কোন উপায়ই নেই। ভক্তি আর শ্রদ্ধায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। কথা বলবে, কিন্তু ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। মুখ খুলল বটে, কিন্তু তোতলাচ্ছে। এর আগেও এরকম হয়েছে। ডনের সামনে কথা বলতে গেলেই তোতলাতে উরু করে। কোনরকমে তার মনের কথা জানাল সে: প্রথমেই গড ফাদার যেন নাতির মুখ দেখেন।