মেহমানদের মধ্যে রয়েছে ভেল চকচকে মাথাওয়ালা চালিয়াত ছোকরা পলি গাটো।মেন বদ মতলবে নয়, যে অভ্যাসের বশে ভাবছে টাকায় ফুলে ওঠা ওই ব্যাগটা কিভাবে হাইজ্যাক করা যায়। ভেবে খুব মজা পাচ্ছে পলি। জানে, খেলনা বন্দুক দিয়ে বাচ্চারা ট্যাঙ্ক উড়িয়ে দেবার যে স্বপ্ন দেখে, তার কল্পনাটাও সেই রকম অলস দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়।
ওর ওপরওয়ালাকে লক্ষ্য করছে পলি। ভারি মোটা, আধাবয়েসী পিটার ক্লেমেনজো। কাঠের মঞ্চের উপর উঠে ছুকরী বয়েসী টসটসে মেয়েদের সাথে ধুমধাড়াক্কা-সর্বস্ব ট্যারান্টেলা নাচছে। যেমন অস্বাভাবিক লম্বা তেমনি চওড়া তার শরীর, অথচ আশ্চর্য বেপরোয়া দক্ষতার সাথে নাচছে সে। মেয়েগুলো বেঁটে বলেই হোক বা ক্লেমেনজোর শক্ত ভুড়িটা প্রতিটা লাফের সাথে সাথে উঁচুতে উঠে যাচ্ছে বলেই হোক, মেয়েগুলোর ফুলে থাকা বুকের সাথে অশ্লীলভাবে ধাক্কা খাচ্ছে। তাই দেখে মেহমানদের কি উল্লাস! এরপর ওর পার্টনার হবার জন্যে একটু বয়স্ক মেয়েরা এগিয়ে এসে ছেকে ধরল ওকে, ওর হাত ধরে টানাহেঁচড়া শুরু করে দিল। ম্যাণ্ডোলিনের উদ্দাম তালের সাথে মিল রেখে হাততালি দিচ্ছে ছোকরাগুলো। এক সময় হাঁপ ধরে গেল ক্লেমেনজোর। যে চেয়ারটায় বসল, সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে গেল সেটা। তাড়াহুড়ো করে এক গ্লাস মদ এনে দিল.ওকে পলি গাটো। রেশমী রুমাল দিয়ে. ওর বিশাল কপালের ঘাম মুছে দিল। তিমি মাছের মত হাঁসফাঁস করছে ক্লেমেনজো, গলায় মদ ঢালছে। ধন্যবাদ দেয়া তো দূরের কথা, চাছাছোলা গলায় বলল, শোনো, নাচের সমঝদার হবার দরকার নেই। কাজ করোগে। সব ঠিক ঠাক আছে কিনা দেখে এসো ঘুরে।
সুড়ুৎ করে ভিড়ের ভিতর ঢুকে গেল পলি।
টিফিনের জন্যে একটু থামল ব্যাণ্ড রাদকরা। পড়ে থাকা একটা ম্যাণ্ডোলিন তুলে নিল এক ছোকরা। নিমো ভ্যালেন্টি। চেয়ারের উপর বাঁ পা তুলে দিয়ে খানিকটা অশ্লীল ধাচের একটা সিসিলীয় প্রেমের গান গাইতে শুরু করল। সুদর্শন চেহারা, কিন্তু মদ খেয়ে ফুলে গেছে মুখটা। আজও এরই মধ্যে নেশা করেছে সে। অশ্লীল পদগুলো জিভ দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে গাইছে নিনো, মেয়েদের দিকে কামাতুর, ঢুলু ঢুলু চোখে তাকাচ্ছে। আর মেয়েগুলো আমোদে আপ্লুত হয়ে চেঁচাচ্ছে। প্রত্যেক চরণের শেষ শব্দটা নিনোর সাথে গলা ফাটিয়ে আওড়াচ্ছে ছেলেরা।
এসব ব্যাপারে গোড়া বলে যথেষ্ট অখ্যাতি আছে ডন কর্লিয়নির। দেখলেন সবার সাথে মেতে উঠে তার মেদবহুল মোটা গিন্নীটিও উল্লাসে চেঁচাচ্ছে। বুদ্ধি করে তিনি বাড়ির ভিতর পালিয়ে গেলেন।
ব্যাপারটা লক্ষ্য করে কনের টেবিলের দিকে এগোল সনি কর্লিয়নি বসল লুনি ম্যানচিনির পাশে। এখন কোন বাধা নেই। পরিবেশনের আগে বিয়ের কেকট্রাতে শেষ সাজ দেবার জন্যে ওর স্ত্রীও গেছে হেঁসেলে।
তরুণী লুসির কানে কানে কিছু বলল সনি। লুসি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল সাথে সাথে। কিন্তু টেবিল ছেড়ে নড়ার কোন লক্ষণ সনির মধ্যে দেখা গেল না। কয়েকটা মুহূর্তকে বয়ে যেতে দিল সে। তারপর উঠল। অনুসরণ করল লুসিকে। ভিড়ের ভিতর দিয়ে যাবার সময় এখানে সেখানে থেমে এর তার সাথে দুটো কথাও বলল, যেন ওর কোন তাড়া নেই বা নির্দিষ্ট কোন কাজ নেই হাতে।
কিন্তু আসল ব্যাপারটা কারও দৃষ্টি এড়াল না। ওদের দুজনের উদ্দেশ্য সবাই জানে। সবাই বুঝল নির্জন কোথাও যাচ্ছে ওরা। কেন যাচ্ছে, তাও জানতে বাকি নেই কারও।
তিন বছর কলেজে পড়ে পুরো আমেরিকান বনে গেছে লুসি ম্যানচিনি। পাকা টসটসে ফলের মত দেখতে মেয়েটা, সবার আলোচনার পাত্রী। বিয়ের তোড়জোর চলার সময় খুব জমিয়ে ছিল সনি কর্লিয়নির সাথে। প্রচুর ঠাট্টা তামাশা করে, খানিকটা মিঠেকড়া ব্যঙ্গের মিশেল দিয়ে চটিয়ে পুরোপুরি খেপিয়ে তুলেছিল সনিকে। ওর ধারণা যেহেতু ও নীত-কনে আর সনি নীত-বর তাই এসবের মধ্যে দোষের কিছু নেই।
পরনের পোলাপী গাউনটা মাটি থেকে একটু তুলে ধরেছে লুসি, মুখে লক্ষ্মী মেয়ের কৃত্রিম হাসি। চঞ্চল পায়ে বাড়ির ভিতর ঢুকল সে। সিঁড়ি বেয়ে সোজা উঠে গেল দোতলায়। এদিক-ওদিক তাকাল। উত্তেজিত দেখাচ্ছে। আপনাআপনি লাল হয়ে উঠেছে চেহারা। হাঁপাচ্ছে। খানিক পরই ব্যাপারটা ঘটবে। আসছে সনি। ওকে আজ নেবে সে। আশ্চর্য এক উষ্ণতা অনুভব করছে লুসি তার শরীরে। শিহরিত বুকে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল। কয়েক মিনিট পর বেরিয়েই দেখতে পেল সনিকে। উপরের ল্যাণ্ডিঙে দাঁড়িয়ে ওর জন্যেই অপেক্ষা করছে। ইশারায় ওকে ডাকলসনি। ঢোক গিলল লুসি। সারা শরীরে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ।
ডন কর্লিয়নির অফিস রূমটা এক কোণায়, সেটা তৈরি করা হয়েছে একটু উঁচু করে। জানালাগুলো বন্ধ, তারই একটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে টমাস হেগেন। বন্ধ জানালার ফাঁক দিয়ে সুসজ্জিত বাগান আর উৎসবমুখর মেহমানদের দেখছে সে। তার পিছনের দেয়ালটা ঢাকা পড়ে আছে বুক শেলফে সেগুলোয় মোটা মোটা সব আইনের বই ঠাসা। টমাস হেগেন একাধারে ডন কর্লিয়নির উকিল এবং কার্যকরী কনসিলিয়রি অর্থাৎ মন্ত্রণাদাতা। কর্লিয়নি পরিবারের ব্যাপারে যারা খাটছে, যারা অধঃস্তন কর্মচারী, তাদের কাছে এই পদের গুরুত্ব অপরিসীম।
ডনের সাথে এই অফিসরুমে বসেই জটিল সব সমস্যা আলোচনা করে হেগেন। ডন উৎসবমুখর বাগান ছেড়ে বাড়িতে ঢুকছেন দেখেই সে বুঝল, আজও তিনি কাজে বসবেন। এরপরই তার নজরে ধরা পড়ল সনি। লুসির কানে কানে কি যেন বলছে সে। গোটা প্রহসনটাই মনোযোগ দিয়ে দেখল হেগেন। গম্ভীর হয়ে একটু ভাবল ডনের কানে কথাটা তুলরে কিনা।