ভিড় থেকে মাইকেলের দূরে সরে বসার কারণ হলো, বাপ এবং আর সকলের কাছ থেকে নিজেকে যে সে স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন করেছে সেটাকে প্রকট ভাবে প্রকাশ করা। পাশে বসে আছে যে মেয়েটি সে ইটালিয়ান নয়, আমেরিকান। সবাই শুনেছে এর কথা, কিন্তু চোখে এই প্রথম দেখছে। মাইকেল অবশ্য ভদ্রতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে সবার সাথে আলাপ করিয়ে দিয়েছে মেয়েটার, তাদের মধ্যে পরিবারের কেউ বাদ পড়েনি।
কেউই মেয়েটাকে দেখে খুব একটা মুগ্ধ হয়নি। একটু বেশি রোগা, বেশি ফর্সা, চেহারাটা মেয়েমানুষের পক্ষে একটু বেশি তীক্ষ্ণ, চোখমুখে সপ্রতিভ ভাবও একটু বেশি, বিশেষ করে কুমারী মেয়ের চেহারায় এতটা চালাক চতুর ভাব না থাকলেই যেন তারা খুশি হত। কে অ্যাডামস-ওর নামটাও একটু বেশি অপরিচিত আর কেমন যেন অদ্ভুত শোনাল ওদের কানে। গত দুশো বছর ধরে ওরা বসবাস করছে আমেরিকায় এবং ওর পদবীটা অত্যন্ত পরিচিত ও জনপ্রিয়, মেয়েটা যদি একথা বলে তাহলেও ব্যাপারটাকে তারা সহজ ভাবে গ্রহণ করতে পারবে না, কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাচ্ছিল্য প্রকাশের সুযোগটাকে সাথে সাথে কাজে লাগাবে। এ নাম ওদের পছন্দ নয়।
মেহমানদের সকলের দৃষ্টি জুনের দিকে। ডন কি করছেন না করছেন সেদিকে সবার গভীর মনোযোগ। জন যে তার ছোট ছেলের দিকে বিশেষ খেয়াল দিচ্ছেন না। এটা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না কারও।
যুদ্ধের আগে পর্যন্ত মাইকেলই ছিল ডনের সবচাইতে প্রিয় সন্তান, তখনই না গিয়েছিল যে উপযুক্ত সময়ে তারকাঁধেই পারিবারিক ব্যবসা পরিচালনার সম্মানজনক দায়িত্ব তুলে দেয়া হবে। মহাপুরুষ বাপের মৌন শক্তি আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির সবটুকু পেয়েছে ও, তারই সাথে যোগ হয়েছে এমনভাবে চলবার একটা জন্মগত ক্ষমতা, যার ফলে কোন মানুষেরই ওকে বন্ধ না করে উপায় নেই।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হতেই একটা পারিবারিক নিষেধাজ্ঞা অমান্য করুন মাইকেল। মেরিন কোরে নাম লিখিয়ে যুদ্ধে যোগ দিল সে। ডন কর্লিয়নি ছেলেকে বিশেষভাবে নিষেধ করলেন। কিন্তু মাইকেল কর্লিয়নি বাপের আদেশের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার প্রয়োজনবোধ করল না।
ডন কর্লিয়নি আমেরিকাকে একটা বিদেশী শক্তি হিসেবে ধরতেন, সেই শক্তির সেবা করতে গিয়ে তাঁর ছোটো ছেলে খুন হবে, এ তিনি চাননি। ঘুষ হিসেবে টাকা পয়সা যা লাগে ডাক্তারকে সেসব দেয়া হয়ে গিয়েছিল, গোপন আর সব ব্যবস্থাও মেরে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়াল মাইকেলের বয়স। একুশ পেরিয়ে গেছে তখন ও। তার ব্যক্তিগত ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করা গেল না। মেরিন কোরে নাম লিখিয়ে যুদ্ধ করতে চলে গেল সে প্রশান্ত মহাসাগরে।
পদক পেল মাইকেল, ক্যাপটেন হলো। ১৯৪৪ সালে ওর কৃতিত্বের সচিত্র বিবরণী ছাপা হলো লাইফ ম্যাগাজিনে, ওর ছবিও ছাপা হলো। বাড়ির লোকজনদের কারও সাহস হয়নি পত্রিকাটা নিয়ে এসে দেখায় ডনকে। তবে ডনের একজন বন্ধু পত্রিকাটা একদিন দেখাল ডনকে। সবটুকু পড়ে দেখে ডন তাচ্ছিল্যের সাথে একটা শব্দ করলেন, বললেন, এ ধরনের অলৌকিক ঘটনা ঘটাচ্ছে ও বিদেশীদের জন্যে।
১৯৪৫ সালের প্রথম দিকে সামরিক বিভাগ থেকে মুক্তি দেয়া হলো মাইকেল কর্লিয়নিকে। আহত ও অক্ষম অবস্থা থেকে যাতে ও সুস্থ হয়ে উঠতে পারে সেজন্যে ডন কর্লিয়নিই ছেলের এই মুক্তির ব্যবস্থা করলেন, কিন্তু মাইকেল এ সম্পর্কে কিছুই জানত না। চুপচাপ কয়েক হপ্তা বাড়িতে বসে থাকল ও। তারপর কাউকে কিছু না জানিয়ে ভর্তি হয়ে গেল হ্যাঁনোভারের ডার্টমান্য কলেজে। অর্থাৎ অবার সে বাপের বাড়ি ছেড়ে সরে গেল দূরে।
বোনের বিয়ে উপলক্ষে এতদিন পর আবার বাড়ি ফিরেছে মাইকেল। ফেরার আরেকটা উদ্দেশ্য হলো: ভাবী স্ত্রীকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া।
মেহমানদের মধ্যে যাদের চাকচিক্য একটু বেশি তাদের সম্পর্কে দুএকটা মজার মজার গল্প বলে ভাবী স্ত্রী কে অ্যাডমসকে হাসাতে চেষ্টা করছে মাইকেল। কে হাসির মত কিছু খুঁজে পাচ্ছে না, বরং মাইকেল যাদের কথা বলছে সেই সব লোককে আশ্চর্য রোমাঞ্চকর বলে মনে হচ্ছে তার। বেশ মজা লাগছে মাইকেলেরও। যা কিছু নতুন, যা কিছু ওর অভিজ্ঞতার বাইরে তাতেই যত কৌতূহল কে-র, এটা লক্ষ করে সত্যিই মুগ্ধ হচ্ছে ও।
ঘরে তৈরি মদে ভরা একটা পিপের চারদিকে ছোটখাটো ভিড় জমেছে একটা। একসময় সেদিকে চোখ পড়ল কে অ্যাডামসের। এরা হলো আমেরিগো বনাসেরা, রুটিওয়ালা নাজোরিনি, এ্যান্টনি কপোলা এবং লুকাব্রাসি। লোক চারজনকে অখুশি দেখাচ্ছে, সচেতন দৃষ্টি এবং ওর স্বাভাবিক বৃদ্ধির সাহায্যে তা ধরে ফেলল কে।
মৃদু হাসল মাইকেল। তুমি ঠিকই ধরেছ। ওরা অপেক্ষা করছে বাবার সাথে দেখা করবে বলে। প্রত্যেকের কিছু না কিছু চাওয়ার আছে। কথাটা ঠিক। ডন যেদিকেই যাচ্ছেন, চারজোড়া চোখ তাকে সারাক্ষণ অনুসরণ করছে।
অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন ডন কর্লিয়নি। এমন সময় শানবাঁধানো উঠানের উল্টো দিকে এসে থামল একটা কালো শেভ্রলে গাড়ি। সামনের সীটে দুজন লোক। কোটের পকেট থেকে নোট বই বের করে উঠানের চারদিকে দাঁড়ানো গাড়িগুলোর নম্বর টুকছে।
ব্যাটারা নির্ঘাৎ পুলিশ, বাপের দিকে তাকাল সনি।
কাঁধ ঝাঁকালেন ডন কর্লিয়নি। রাস্তাটার মালিক তো আর আমি নই। যা খুশি তাই করতে পারে ওরা।