ধনী হোক বা গরীব, ক্ষমতাশালী হোক বা দুর্বল, আচরণে কারও প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্ব প্রকাশ পাচ্ছে না, সমান আন্তরিক প্রীতির সাথে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছেন ডন কর্লিয়নি। কাউকে তিনি অনাদর করছেন না। তাঁর স্বভাবই এই। মেহমানরাও বিগলিত বিনয়ে বারবার স্বীকার করছে, কালো সান্ধ্য পোশাকে তাকে ভারি সুন্দর মানিয়েছে–অজ্ঞ যে কোন লোক তাকে দেখে ভাববে তিনিই বুঝি ভাগ্যবান বর।
তিন ছেলের মধ্যে দুজন বাপের সাথে সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বড় ছেলে সানতিনা, বাবা ছাড়া আর সবাই তাকে সনি বলে ডাকে।
সনির দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে বয়স্ক ইটালিয়ান ভদ্রলোকেরা। তাকিয়ে আছে যুবকরাও, তাদের চোখে শ্রদ্ধামাখা দৃষ্টি। এক পুরুষ ধরে ইটালিতে বসবাসরত মা বাপের ছেলেরা সনির মত এতটা লম্বা হয় না। প্রায় ছফুট। এলোমেলো কোঁকড়া চুল মাথায়, ফলে তাকে আরও বেশি লম্বা মনে হয়। মুখটা দেখতে খানিকটা স্থল, কিউপিডের মত। নিখুঁত নাক চোখ! ঠোঁট দুটো পুরু এবং ধনুকের মত বাকা, যা দেখে তাকে ইন্দ্রিয়াসক্ত বলে চেনা যায় সহজেই। ঠোঁটের নিচেই টোল খাওয়া থুতনিতে অদ্ভুত একটা, অশ্লীলতার লক্ষণ রয়েছে।
শক্তিশালী ষাঁড়ের মত শরীর সনির। সবাই বলে প্রকৃতি নাকি ওকে এমন উদার হস্তে দান করেছে যে অতীতে অবিশ্বাসীরা ব্ল্যাক নামের যন্ত্রটাকে যে রকম ভয় করত, ওর নির্যাতিতা স্ত্রী বেচারীও ওর যন্ত্রটাকে সে-রকম ভয় পায়। গুজবে প্রকাশ, মাত্র কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণে পৌঁছেটে তখন সনি, বারবনিতা পল্লীর সবচেয়ে ডাকসাইটে দুর্ধর্ষ মেয়েগুলোও নাকি ওর বিশাল যন্ত্রটা দেখা মাত্র প্রচলিত দরের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দরহেঁকে বসত।
আজকের এই বিয়ে বাড়িতে চওড়া নিতম্ব নিয়ে কমবয়েসী কজন গিন্নী এসেছে, মুখে গাভীর্য অটুট রেখে চোখা দৃষ্টিতে তারা মাপ নিচ্ছে সনি কর্লিয়নির। তবে আজ ওদের বরাত খারাপ, কৌনো আশা নেই। কারণ, অনুষ্ঠানে স্ত্রী এবং বাচ্চা-কাচ্চারা উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও লুসি ম্যানচিনিকে নিয়ে অন্য মতল রয়েছে সনির। বোনের বান্ধবী লুসি, উৎসবের গোলাপী পোশাক পরে এসেছে। মাথায় কালো, চকচকে চুলের উপর শোভা পাচ্ছে ফুলের মুকুট। বাগিচায় একটা টেবিলের কাছে বসে আছে; সনির মতলব সম্পর্কে পূর্ণ সচেতনসে।
গত এক হপ্তা ধরে চলেছে বিয়ের আয়োজন, লুসি ম্যানচিনি দীর্ঘ সাতদিন সময় পেয়েছে সনির সাথে ভাব জমাবার। আজ সকালেও এক কাণ্ড করেছে সে, বিয়ের একটা খণ্ড অনুষ্ঠানে সুযোগ পেয়েই হাত চেপে ধরেছিল সনির। কুমারী সে, এর চাইতে বেশি আর কতদূর এগোতে পারে?
সনি কর্লিয়নি তার বাপডন কর্লিয়নির মত একজন মহাপুরুষ হয়ে উঠবে না, কিন্তু সে ব্যাপারে কোন মাথাব্যথা নেই লুসি ম্যানচিনির। গায়ে জোর আর বুকে বল আছে; সনির। হৃদয়ে উদারতার কোন অভাব নেই তার। তবে বাপ যেমন বিনয়ী, ছেলে তার ধারে কাছেও যেতে পারে না। চট করে রেগে ওঠে সনি, আর রেগে গেলেই বিচার বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। একথা ঠিক যে ব্যবসায় তার বাপকে সর্ব রকম সাহায্য করে সে, কিন্তু তবু এই সনিই তার উত্তরাধিকারী হবে কিনা সে বিষয়ে জোর করে কিছুই বলা যায় না।
ফ্রেড বা ফ্রিডো বলে ডাকে সবাই মেজ ছেলেকে, নাম ফ্রেডারিকো। এমন একটা ছেলের জন্যেই প্রার্থনা করে থাকে সব ইটালিয়ান মা বাপেরা। ফ্রেড যেমন কর্তব্যপরায়ণ, তেমনি বিশ্বাসী। বাপের হুকুম পাবার জন্যে সদা সর্বদা একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে বললেও অত্যুক্তি হয় না। ত্রিশ বছর বয়সেও মা বাপের সাথে বসবাস করছে সে। একটু বেঁটে, গড়নটাও বেশ ভারি, ঠিক সুপুরুষ বলা যায় না তাকে। কর্লিয়নি পরিবারের চেহারাগত বৈশিষ্ট্যগুলো ওর মধ্যে উপস্থিত: গোল মুখ, কিউপিডের মাথার উপর কোঁকড়া চুলের মুকুট, ঠোঁট ধনুকের মত বাঁকা। ঠোঁট বাকা হলেও সনির সাথে তফাৎ এই যে ফ্রেঙের ঠোঁটে কামুকতার চিহ্ন নেই, গ্র্যানাইট পাথরে খোদাই করা বলে মনে হয়।
চেহারা এবং আচার-ব্যবহারে শক্ত নীরস একটা ভাব আছে ফ্রেডের। তবু সেই তো বাপের একমাত্র অবলম্বন, কখনও মুখের উপর তর্ক করে না বা মেয়ে ঘটিত ব্যাপারে ঝামেলায় পড়ে তার অপমান করে না। এই ধরনের যথেষ্ট গুণ থাকলেও ফ্রেডের চরিত্রে সেই প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ব নেই যা মানুষকে আকর্ষণ করে, নেই সেই বুনো জন্তুর মত প্রবল প্রাণশক্তি-জননেতা হতে চাইলে যা না থাকলেই নয়। বাপের উত্তরাধিকারী হবার সম্ভবনা তারও নেই বললেই চলে।
ছোট ছেলে মাইকেল।
বাবা আর ভাইদের সাথে সদর দরজায় না দাঁড়িয়ে বাগানের নির্জনএক কোণে একটা টেবিলের কিনারায় বসে আছে মাইকেল কর্লিয়নি। সযত্নে দূরে সরে থাকার চেষ্টা করলেও আত্মীয় স্বজনের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি সে।
ডনের ছোট ছেলে মাইকেল, প্রবল প্রতাপশালী জন্মদাতার শাসন একমাত্র সেই মেনে চলতে রাজি নয়। ভাইদের সাথে কোথাও তেমন কোন মিল নেই মাইকেলের। কিউপিডের মত ভারি নয় তার মুখ, চুলগুলো কুচকুচে কালো, কিন্তু কোঁকড়া নয়। গায়ের চামড়া চকচকে সোনা রঙ মেশানো বাদামী, সাধারণত রূপসী মেয়েদের গায়ের রঙও এমন সুন্দর হতে দেখা যায় না। কোমল একটা রূপ আছে মাইকেলের। একটা সময় গেছে যখন ছেলের পুরুষত্ব সম্পর্কে চিন্তিত ছিলেন জুন। সতেরো বছরে পৌঁছে বাগের মিথ্যে দুর্ভাবনা অবশ্য দূর করে দিয়েছিল মাইকেল।