কাঁদছে ক্যাথারিন। এরই মধ্যে গায়ে মেদ জমতে শুরু করেছে তার। মুখটা সাদামাঠা, মিহি গোঁফের রেখা ঠোঁটের ওপর। তার চোখে সুদর্শন পুরুষ এনজো, তার মনে হয়, শ্রদ্ধা মেশানো প্রেমের সাথে তার শরীরের গোপন জায়গাগুলোয় যেভাবে হাত দেয় সেভাবে আর কোন পুরুষ হাত দেবে না। শালিক পাখির মত চেঁচামেচি জুড়ে দিল সে।
ঠিক আছে, ইটালিতে গিয়েই থাকব আমি, বলল ক্যাথারিন। তোমরা এনজোকে এখানে রাখার কোন ব্যবস্থা যদি না করো, আমাকেও পালিয়ে যেতে হবে।
আড়চোখে তার দিকে তাস্কাল নাজারিনি। বহুত ঘোড়েল তার এই মেয়েটা। নজর এড়ায়নি তার, তন্দুর থেকে গরম রুটি বের করে খদ্দেরদের টেবিলের দিকে এগোলেই ক্যাথারিন তার সুগঠিত নিতম্ব এনজোর গায়ে ঘষে দেয়। একটা ব্যাপারে এখন নাজোরিনির মনে কোন সন্দেহ নেই: সময় থাকতে একটা সমাধান বের করতে না পারলে ছোকরার গরম রুটি মেয়েটার তন্দুরে উঠবে।
আমেরিকায় স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে এনজোকে। মাত্র একজন ভদ্রলোক আছেন, যিনি এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন। তিনি গড় ফাদার। ওর ধর্মপিতা। ডন কর্লিয়নি।
.
উনিশ শো পঁয়তাল্লিশ সাল। আগস্ট মাসের শেষ শনিবার। আরও অনেকের সাথে এই কজনও মিস কনস্ট্যানসিয়া কর্লিয়নির বিয়ে উপলক্ষে এনগ্রেভ করা নিমন্ত্রণপত্র পেল।
কনের বাপ ডন ভিটো কর্লিয়নি আজকাল লং আইল্যাণ্ডের প্রকাণ্ড একটা বাড়িতে থাকেন, কিন্তু পুরানো বন্ধু-বান্ধব কিংবা প্রতিবেশীদের কথা কখনও তিনি, ভুলে যান না। যাদেরকে তিনি চেনেন, যারা তার বন্ধু ছিল এককালে, যারা তার প্রতিবেশী হবার গৌরবের অধিকারী তাদের সবাইকে তিনি মনে রেখেছেন, নিমন্ত্রণ করতেও ভোলেননি।
বিয়ের আয়োজন লং আইল্যান্ডের এই বাড়িটিতেই করা হয়েছে। সারাদিন ধরে এখানে চলবে তুমুল আমোদ-আলাদ। জাপানীদের সাথে যুদ্ধ থেমেছে মাত্র, কারও ছেলে যুদ্ধ করছে না, সুতরাং আনন্দফুর্তি উপভোগ করতে অসুবিধে নেই কারও। উদ্দাম আনন্দ প্রকাশ করার জন্যে বিয়েবাড়ির উৎসবের মত পরিবেশ আর আছে নাকি।
শনিবারের সকাল।
নিউ ইয়র্ক শহর থেকে বিশাল জনমোত বেরিয়ে আসছে। গন্তব্যস্থান লং আইল্যাণ্ড। এরা সবাই ডন কর্লিয়নির বন্ধু-বান্ধব। গড ফাদারের দাওয়াত পেয়ে প্রত্যেকে গর্বিত, কৃতজ্ঞ এবং ধন্য। ধর্মপিতার প্রাপ্য সম্মান দিতে দলে দলে চলেছে তারা। চেক নয়, ঘিয়ে-রঙা এনভেলাপে ভরে নগদ টাকা নিয়ে এসেছে সবাই, বর কনেকে উপহার দেবার জন্যে। সবার এনভেলাপে একটা করে কার্ড আছে, সেই কার্ডে দাতার পরিচয় এবং গড ফাদারের প্রতি তার ভক্তি ও শ্রদ্ধার মাত্রাও উল্লেখ করা হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, তাদের এই সীমাহীন ভক্তি-শ্রদ্ধা পাবার যোগ্যতা গড ফাদার ডন ভিটো কর্লিয়নির আছে।
সাহায্যের জন্যে এসে ডন কর্লিয়নির কাছ থেকে কখনও খালি হাতে ফিরে যায় কেউ। কাউকে তিনি বিমুখ করতে জানেন না। প্রতিশ্রুতি দিলে তা রক্ষা করেন তিনি, কাউকে কখনও মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেন না। তার চেয়েও শক্তিশালী কোন পক্ষের কাছে তার হাত পা বাধা, এ ধরনের কাপুরুষোচিত অজুহাত কখনও দেখান না তিনি। তাঁর সাথে যে-কেউ বন্ধুত্ব করতে পারে, সবার বন্ধু হবার জন্যে তিনি সব সময় প্রস্তুত হয়ে আছেন। সাহায্য পেতে হলে তার সাথে বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখতে হবে, এমন কোন শর্তও নেই। ঋণ শোধ করার সঙ্গতি নেই যার তাকেও তিনি সাহায্য করেন, বিনিময়ে তার কাছ থেকে কিছুই চান না। মাঝখানে কথা আছে মাত্র একটা; সাহায্য যে পেতে চায় তাকে যেচে পড়ে তার কাছে আসতে হবে, বন্ধুত্ব পাতাতে হবে। ব্যস, শুধু এইটুকু।
সাহায্য প্রার্থী সর্বহারা হোক, দুর্বল হোক, কিছু এসে যায় না তার সমস্ত সমস্যা; বিপদ, দুশ্চিন্তা নিজের কাঁধে তুলে নেবেন ডন কর্লিয়নি। তার বিপদকে নিজের বিপদ হিসেবে গ্রহণ করবেন। তাকে বিপদ মুক্ত করার জন্যে, তার দুঃখ দূর করার জন্যে দরকার হলে সাধ্যের বাইরে চেষ্টা করবেন তিনি, শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে লড়বেন। সামনে যত বাধাই আসুক, মানবেন না। কিন্তু বিনিময়ে? এর বিনিময়ে কিছুই কি চান না তিনি?
চান। বন্ধুত্ব চান। চান মর্যাদার প্রতীক ডন হিসেবে স্বীকৃতি। কখনও বা আরও মধুর সশ্রদ্ধ সম্বোধন-গড় ফাদার। এবং এর সাথে হয়তো নগদ প্রাপ্তি হিসেবে নয়, শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ ঘরে তৈরি এক গ্যালন মদ, কিংবা যত্ন করে বেক করা এক ঝুড়ি ঝাল নিমকি পেলে খুশি হন। তাছাড়া, ব্যাপারটা যদিও সামান্য লৌকিকতা ছাড়া কিছু নয়, তবে সকলেরই জানা আছে যে সামনে দাঁড়িয়ে তোমাকে বলতে হবে, তাঁর কাছে তুমি কৃতজ্ঞ এবং ঋণী, প্রয়োজনে নগণ্য কোন কাজ করে দিয়ে সে ঋণের প্রতিদান চাওয়ার অধিকার তাঁর থাকল।
বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন ডন ভিটো কর্লিয়নি। অতিথিরা সবাই তার পরিচিত, সবাইকে তিনি বিশ্বাস করেন। এদের মধ্যে এমন লোকের সংখ্যা প্রচুর যারা তাদের সমস্ত জীবনের সাফল্যের জন্যে তার কাছে চিরঋণী হয়ে আছে। আজকের এই শুভ অনুষ্ঠান উপলক্ষে তাকে তারা প্রকাশ্যে গড। ফাদার বলে ডাকতেও সাহস পাচ্ছে। বাড়িতে কাজকর্ম করছে যারা তারাও সবাই তাঁর বন্ধু বান্ধব। টেবিলে মদের পাত্র সাজাবার দায়িত্ব নিয়েছে যে, সে-ও তার একজন পুরানো বন্ধু, বন্ধুত্বের প্রতিদান হিসেবে যত মদ লাগছে, সবই যোগান দিচ্ছে সে। তার ছেলেদের বন্ধুরা দায়িত্ব নিয়েছে পরিবেশনের। বাগানে ফেলা হয়েছে পিকনিক টেবিলগুলো। ডনের স্ত্রী আর তার বান্ধবীদের রান্না করা উপাদেয় খাবারগুলো সেখানে সাজানো হয়েছে। কনের তরুণী বান্ধবীরা রঙ বেরঙের মালা দিয়ে সাজিয়েছে বাগানের এক একর জায়গা।