পানিতে দুচোখ ভরে গেছে কে-র। ধরা গলায় বলল, কিন্তু যা হবার তা তো হয়েই গিয়েছিল। সবাই সুখে ছিলাম আমরা। ক্ষমা করা যেত না কার্লোকে? কেন যেত না? অতীত তো ভুলেও যাওয়া যায়, কার্লোর ব্যাপারটা যদি সবাই ভুলে যেত, কি এমন ক্ষতি হত তাতে তাকে মেরে ফেলে লাভটা কি হলো?
মাঠের ওপর দিয়ে হাঁটছে ওরা। নদীর ধারে এসে গাছের ছোট একটা ছায়ার নিচে ঘাসের ওপর বলল দুজন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল হেগেন। চারদিকের শান্ত, সুন্দর শান্তিময় প্রাকৃতিক দৃশ্যের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। তারপর বলল, ক্ষমা? হ্যাঁ, তোমাদের এই জগতে তা করা যায়।
ওকে আমি বিয়ে করিনি, বলল কে। যাকে বিয়ে করেছিলাম তাকে খুঁজে পাচ্ছি না ওর মধ্যে।
তা যদি পেতে, কোমল কণ্ঠে হাল হেগেন, এতদিনে মরে ভূত হয়ে যেত ও। অবশ্য বিধবা হলে কোন সমস্যা থাকত না তোমার।
দপ করে জ্বলে উঠল কে। এ কি ধরনের জন্য মনিকতা! একটু থেমে আবার বলল সে, তুমি তো সিসিলিয়ান নও, একজন মেয়েকে সত্যি কথা বলতে পারো তুমি। একজন মানুষকে মানুষ বলে মনে করা তোমার পক্ষে সম্ভব। জীবনে এই একবার সত্যি কথাটা আমাকে বলো তুমি, টম।
সাথে সাথে কোন জবাব দিল না হেগেন! খানিক পর এদিক ওদিক মাথা নেড়ে বলল, ওকে তুমি ভুল বুঝছ। তোমার রাগের কারণ ও তোমাকে মিথ্যে কথা বলেছে, কিন্তু ও তো,তেমাকে ওর কাজকর্মের ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করতে নিষেধ করেছিল, সেটা ভুলে যাচ্ছ কেন? কনির ছেলের গড ফাদার হয়েছিল ও, সেজন্যে ভাবছ ও তোমাকে বোকা বানিয়েছে কিন্তু তুমিই না বিশেষভাবে অনুরোধ করে রাজি করিয়েছিলে ওকে? তবে কৌশলের দিক থেকে বিচার করলে কাজটা করে বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিল ও, কার্লোর মন থেকে সংশয় দূর করার জন্যে বেশ ফল দিয়েছিল ওটা। অতি প্রাচীন একটা নিয়ম, শত্রুকে আশ্বস্ত করা। হেগেনের সিটা দেখে ওকে হৃদয়হীন মনে হলো কে-র। সত্যি কথাগুলো বলছি তোমাকে, বিশ্বাস করছ কি?
মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে কে।
আরও কিছু সত্যি কথা বলি, কেমন? আবার শুরু করল হেগেন। ডন কর্লিয়নি মারা যাবার পর মাইকেলকে খুন করার ষড়যন্ত্র পাকানো হয়। জানো, কার হাত ছিল এতে? টেসিওর। তাই মরতে হলো তাকে! বিশ্বাসঘাতকতার ক্ষমা নেই, তাই কার্লোকেও মরতে হলো। ওদেরকে মাইকেল যদিও বা ক্ষমা করতে পারত, নিজেদেরকে ওরা কখনোই ক্ষমা করতে পারত না। তাই চিরকালের জন্যে বিপদের একটা কারণ হয়ে থাকত ওরা। তুমি হয়তো জানো না, কিন্তু আমি তো জানি, টেসিওকে খুবই পছন্দ করত মাইকেল। কনিকে ও সত্যি সত্যিই ভালবাসে। কিন্তু টেসিও আর কার্লোকে ক্ষমা করলে মাইকেল তোমার আর তোমার ছেলেদের, নিজের গোটা পরিবার, আমার আর আমার পরিবারের ওপর অন্যায় করত। কর্তব্যে অবহেলা করা ওর মত একজন পরিবার প্রধানের সাজে না। ওরা বেঁচে থাকলে আমাদের ব্যর বিপদের কারণ হয়ে থাকত। চিরকাল।
চোখ থেকে নিঃশব্দে পানি ঝরছে কে-র। জানতে চাইল, মাইকেল কি এসব কথা বলার জন্যে তোমাকে পাঠিয়েছে?
আশ্চর্য হয়ে গেল হেগেন। কিছুক্ষণ অবাক চোখে কের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বলল, না। সে তোমাকে বলতে বলেছে, তুমি যা চাইবে তাই হবে, তোমার কোন ইচ্ছায় বাদ সাধবে না সে। যতদিন ছেলেদের যত্ন নিচ্ছ, ততদিন যা চাইবে তাই পাবে তুমি.। হঠাৎ হাসল হেগেন। বলেছে, তুমিই তার ডন। এটা কিন্তু ঠাট্টা।
হেগেনের একটা কনুই চেপে ধরল কে। আর সব কথা যে বললে ওগুলো আমাকে শোনাতে বলে দেয়নি?
এক সেকেণ্ড ইতস্তত করতে দেখা গেল টম হেগেনকে, যেন ভাবছে চরম সত্যি কথাটা প্রকাশ করবে কিনা। অবশেষে বলল, শোনো তাহলে। তোমাকে আজ যা বলেছি, মাইকেল যদি কোনদিন জানতে পারে, আমাকে আর বেঁচে থাকতে হবে না। একটু থেমে আবার বলল, দুনিয়ায় শুধু তোমার আর তোমার ছেলেদের কোন ক্ষতি করতে পারে না ও।
পাঁচটা মিনিট চুপচাপ গাছের ছায়ায় বসে থাকল ওরা তারপর উঠে দাঁড়াল কে! দেখাদেখি হেগেনও উঠল। বাড়ির দিকে হাঁটছে ওরা।
বাড়ির একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে হেগেনকে স্কুলল কে, ডিনারের পর আমাকে তুমি নিউ ইয়র্কে নিয়ে যেতে পারবে?
সেজন্যেই তো এখানে আসা আমার, বলল হেগেন।
স্বামীর কাছে ফিরে এল কে। ফিরে আসার এক হপ্তা পর ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষা নিল ও।
.
ঢং! ঢং!
গির্জার গহীন কোথাও করুণ অনুতাপের সুরে ঘণ্টা বাজছে ঠিক যেভাবে শেখানো হয়েছে, মুঠো পাকানো হাত দিয়ে নিজের বুকে হালকাভাবে আঘাত করল কে। অনুতাপ প্রকাশের এই হলো ভাষা।
আবার ঘন্টা বাজার সাথে সাথেই নরম আওয়াজ পাওয়া গেল পায়ের। বেদার পাদদেশে, রেইলিং-এর ধারে গিয়ে দাঁড়াল প্রার্থীরা নিজের বুকে আবার আঘাত করল কে।
ওর সামনে এসে দাঁড়ালেন ধর্মযাজক। মাথাটা পিছন দিকে হেলিয়ে, মুখ হাঁ করল কে, গ্রহণ করল ওয়েফার প্রসাদ।
পাপ মুক্ত হয়েছে কে, দাক্ষিণ্য পেয়েছে দেবতার, মাথা নিচু করে বেদীমূলে কপাল ঠেকাল সে, হাত দুটো জোড় করে রাখল। একটু নড়েচড়ে বসল, ব্যথা যাতে একটু কম লাগে হাঁটুতে।
তারপর মন থেকে সমস্ত চিন্তা দূর করে দেবার চেষ্টা করল কে। নিজের কথা ভুলে গেল, ভুলে গেল নিজের সন্তানদের কথা। সব রাগ, সব ঘৃণা, সমস্ত দুঃখ আর সব বিদ্রোহ ঝেড়ে ফেলল মন থেকে। তারপর বিশ্বাস করার প্রবল, সুগভীর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে, সৃষ্টিকর্তা যেন তার আকুতি বুঝতে পারেন এই ভিক্ষা চেয়ে, মাইকেল কর্লিয়নির আত্মার মুক্তির জন্যে বাছাই করা প্রার্থনা আবৃত্তি করতে শুরু করল সে।