শুধু এইখানে, এই খিলান দেয়া গির্জার ছায়াছায়া অন্ধকারে কে তার স্বামীর জীবনের আরেকটা দিকের কথা ভাবতে অনুমতি দেয় নিজের মনকে। এখানে বসে, এই সময় এক বছর আগে সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা স্মরণ করে সে। পরস্পরের প্রতি ওদের যে প্রেম আর ভালবাসা রয়েছে তার সুযোগ নিয়ে একটা মিথ্যে কথা তাকে বিশ্বাস করার চেষ্টা করেছিল মাইকেল। বলেছিল, সে তার নিজের ভগ্নীপতিকে খুন করেনি।
অপরাধটার জন্যে নয়, মিথ্যেটার জন্যে স্বামীকে শ্রাগ করে চলে গিয়েছিল কে।
.
এক বছর আগের ঘটনা।
দুই ছেলেকে নিয়ে সোজা বাপের বাড়ি নিউ হ্যাম্পশায়ারে চলে এল কে। লং বীচের কাউকে কিছু বলে আসেনি, কি করবে তাও ভাল করে ভেবে দেখেনি। এখনও।
পরিস্থিতিটা সাথে সাথে বুঝে নিয়েছে মাইকেল। প্রথম দিন একটা ফোন করল কে-কে, তারপর তাকে আর বিরক্ত করেনি।
একটা হপ্তা কেটে গেল। তারপর একদিন একটা লিমুসিন গাড়ি এসে দাঁড়াল কে-র বাপের বাড়ির সামনে। গাড়িটা নিউ ইয়র্ক থেকে এসেছে। সেটা থেকে নামল টমহেগেন।
এই একটা দুপুরের কথা জীবনে কখনও ভুলবে না কে। ওর জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দুপুর।
বেড়াতে বেরিয়ে শহর ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে গেল ওরা, সেই বনভূমি পর্যন্ত। টম হেগেনকে ছেড়ে কথা বলল না সে।
নির্দয়ভাবে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করার চেষ্টা করল কে। উচিত হয়নি, কেননা ও যে রকম মেয়ে, এত বেশি সরল, তাতে খোঁচা মারার কায়দা-কৌশল রপ্ত করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। চেষ্টা করল, কিন্তু সুবিধে করতে পারল না। সে বুঝি আমাকে ভয় দেখাবার জন্যে পাঠিয়েছে তোমাকে? হেগেনকে জিজ্ঞেস করল, তোমার গাড়ি থামতে দেখে আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম হাতে পিস্তল-রিভলভার নিয়ে তোমাদের গুণ্ডাপাণ্ডারা লাফ দিয়ে নামতে যাচ্ছে। ভাবছিলাম, এই রে, এবার আমাকে টেনে হিঁচড়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।
এর আগে হেগেনকে কখনও রাগতে দেখেনি কে, এখন দেখছে। চোখমুখ টকটকে লাল হয়ে উঠল গর, গলার স্বর বদলে গিয়ে এমন কর্কশ হয়ে গেল যে চেনাই যায় না। তুমি কচি খুকীটি নও, কে। এই রকম একটা ছেলেমানুষি ঠাট্টা কিভাবে করো? তোমার মত মেয়ের কাছ থেকে আরও গাম্ভীর্য, আরও বুদ্ধি আশা করি আমি। মাটিতে পা দাও, কে।
বেশ, বলল কে।
পায়ের নিচে কচি সবুজ ঘাস। মফঃস্বলের কাঁচা রাস্তা দিয়ে হাঁটছে ওরা। চলে এলে কেন? শান্তভাবে জানতে চাইল হেগেন।
মূহুর্তে উত্তেজিত হয়ে উঠল কে। বলল, একজনমিথ্যেবাদীর সাথে ঘর করতে পারব না, তাই। আমাকে সে মিথ্যে কথা বলল কেন? চলে এসেছি, কারণ কনির ছেলের গড় ফাদার হয়ে অনেক আগেই বোকা বানিয়েছিল আমাকে সে, তাই সে তার স্ত্রীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তাই এই রকম একজন লোককে ভালবাসতে পারব না আমি। স্বামীর চরিত্রে যদি এমন সাঙ্ঘাতিক ধরনের স্বলন থাকে, তাকে আমি সহ্য করতে পারব না-জানি বলেই চলে এসেছি। ওকে আমি আমার ছেলেদের বাপের দায়িত্ব পালন করার অধিকার দিতে রাজি নই।
প্রলাপ বকছ নাকি? বলল হেগেন। তোমার একটা কথাও তো বুঝতে পারলাম না আমি!
এতক্ষণে রাগ দেখাবার সঙ্গত একটা কারণ ঘটল, এবং সুযোগটা হাতছাড়া করল না কে, বলল, আমার কথা বুঝতে পারছ না? মাইকেল কর্লিয়নি তার ভগ্নীপতিকে খুন করেছে, আমি সেই কথা বলছি। এবার বুঝতে পারছ কি বলতে চাইছি? একটু বিরতি নিল কে, তারপর আবার বলল, মাইকেল কর্লিয়নি আমার স্বামী হয়ে আমাকে মিথ্যে কথা বলেছে, আমি সেই কথা বলছি। বুঝতে পারছ এবার?
দুজনের কেউই অনেকক্ষণ কথা বলল না। চুপচাপ হাঁটছে।
তারপর হেগেনই প্রথমে মুখ খুলল, এসব অভিযোগ যে সত্যি তা জানার কোন উপায় নেই। তবু না হয় তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া গোল কথাটা সত্যি। আসলেই সত্যি, তা কিন্তু বলছি না-সেটা ভুলে ভেবে বোসা না। কিন্তু যদি বলি, মাইকেল যা করেছে তার পিছনে ন্যায্য যুক্তি ছিল? অন্তত যদি বলি যে ন্যায্য কারণ থাকা সম্ভব, তাহলে?
হেগেনের দিকে তাকাল কে, তার দৃষ্টিতে রাজ্যের তাচ্ছিল্য ফুটে উঠল। বলল, তোমার ওকালতির দিকটা এই প্রথম দেখতে পাচ্ছি আমি। ওটা তোমার শ্রেষ্ঠ দিক নয়, টম।
নিঃশব্দে হাসল টম হেগেন। আচ্ছা, বুঝলাম। কিন্তু আমার সবটা কথা আগে শোনোই তো। যদি বলি, কার্লোই বাৰ্জিনিদের হাতে তুলে দিয়েছিল সনিকে? সে রাতে কনিকে অস্বাভাবিক রকম মারধর করেছিল। যদি বলি, ওটা একটা ষড়যন্ত্র ছিল? ওই ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য ছিল সনিকে বাড়ির বাইরে বের করে আনা? যদি বলি, বার্জিনিরা জানত জোনস বীচ ব্রিজের ওপর দিয়ে যাবে সনি? তারপর, আরও যদি বলি, সনিকে শত্রুদের হাতে তুলে দেবার বিনিময়ে প্রচুর টাকা খেয়েছে কার্লো, তাহলে? তাহলে কি বলবে তুমি?
চুপ করে আছে কে।
বলার কথা আরও আছে, থামছে না হেগেন, ধরো, এমন ঘটে থাকে, যে ডন ভিটো কর্লিয়নি একজন মহাপুরুষ ছিলেন বলেই ছেলের খুনের বদলা নেবার জন্যে জামাইকে হত্যা করতে নিজের বিবেককে রাজি করাতে পারেননি, সেটাই তার একমাত্র কর্তব্য জানার পরও যদি বলি এই অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব তিনি পালন করতে পারবেন না বুঝতে পেরেই তার ছোট ছেলে মাইকেলকে উত্তরাধিকারী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, কেননা তিনি ভালভাবেই জানতেন একমাত্র মাইকেলই তার কাঁধ থেকে সে দায়িত্বের বোঝ, সে-পাপের বোঝা নামিয়ে নিতে পারবে?