বার্জিনি মারা গেছে, শান্তভাবে বলল মাইকেল। টাটাগ্লিয়াও নেই আজ রাতেই পরিবারের সব দেনা-পাওনার হিসাব চুকিয়ে ফেলতে চাই আমি তাই, তুমি নির্দোষ এ-কথা শুনিয়ে না আমাকে। যা করেছ তা স্বীকার করাই তোমার জন্যে ভাল হবে।
অবাক হয়ে মাইকেলের দিকে তাকিয়ে আছে টম হেগেন আর রকো ল্যাম্পনি। ওরা ভাবছে, এখনও বাপের মত হয়ে উঠতে পারল না মাইকেল এই বিশ্বাসঘাতকটাকে দিয়ে অপরাধ স্বীকার করার দরকারটা কি? এ-ধরনের একটা ব্যাপার যতটুকু প্রমাণ করা যায় ততটুকু প্রমাণ তো পাওয়াই গেছে উরেটা দুয়ে দুয়ে চারের মত সহজ। কিন্তু নিজের অধিকার সম্পর্কে এখনও ততটা নিশ্চিন্ত হতে পারছে না মাইকেল। এখনও তার মানে অন্যায় করে ফেলার ভয় ক্ষীণ একটু সন্দেহে এখনও ভুগছে সে কার্লোর স্বীকারোক্তিই শুধু তা দূর করতে পারে
কিন্তু কার্লো এখনও চুপ করে আছে।
তোমার এত ভয় পাবার কিছু নেই। প্রায় সদয় কণ্ঠে বলল মাইকেল তুমি আমার বোনের স্বামী, ওখানেই আমার হাত-পা বাধা তাকে তো আর বিধবা করতে পারি না আমি। তাছাড়া ভাগ্নেদের মুখও চাইতে হবে আমাকে ওদেরকে বাপ-হারা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ভুলে যাচ্ছ কেন, তোমার একটা ছেলের গড় ফাদার আমি। না, তুমি যা ধরে নিয়েছ তা আমি করতে যাচ্ছি না। তোমাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া মানে, যাদেরকে আমি আমার শরীরের অংশ বলে মনে করি, তাদের ক্ষতি করা–তা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তোমার শাস্তি হবে, কর্লিয়নি পরিবার তোমাকে বিশ্বাস করে আর কোন কাজ করতে দেবে না কখনও। কর্নিয়নি পরিবারের কাজ করে খুব ভাল রোজগার করতে ভূমি, সেই সুযোগটা হারাতে যাচ্ছ! লাস ভেগাসে স্ত্রী আর ছেলেদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে তোমাকে, ওখানেই থাকবে তুমি। আমরা ধু একটা মাসোহারা দেব কনিকে। ওই পর্যন্তই, তার বেশি কিছু নয়। কিন্তু ওই কথাটা যেন তোমার মুখে আবার আমাকে শুনতে না হয়–আমি নির্দোষ। কথাটা বলে তুমি আমার বুদ্ধিকে অপমান করছ। আমাকে খেপিয়ে দিলে তার ফল ভাল হবে না। প্রস্তাবটা কে নিয়ে এসেছিল তোমার কাছে, বাৰ্জিনি? নাকি টাটাগ্লিয়া?
বাঁচার তীব্র আকুতি ফুটে উঠল কার্লোর চেহারায়। ওকে মেরে ফেলা হবে না শুনে মুক্তির ঝিরঝিরে একটা শান্তির পরশ অনুভব করছে সারা শরীরে। বার্জিনি, ফিসফিস করে বলল সে।
বেশ, বেশ, নরম গলায় বলল মাইকেল। ডান হাত তুলে দরজাটা দেখিয়ে দিল ও। বেরোও। বাইরে গাড়ি অপেক্ষা করছে তোমার জন্যে। সোজা এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবে।
চঞ্চল পায়ে সবার আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল কার্লো। ওকে অনুসরণ করছে মাইকেল। পিছনে হেগেন আর রকো ল্যাম্পনি।
ইতিমধ্যে সন্ধ্যা উতরে গেছে। তবে রোজকার মত আজও ফ্লাড লাইটের আলোয় ঝলমল করছে প্রকাণ্ড উঠানটা। প্রায় নিঃশব্দে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল কার্লোর সামনে। আগেই দেখতে পেয়েছে ও গাড়িটাকে, কিন্তু চিনতে পারেনি। এখন দাঁড়িয়ে পড়ার পর দেখল ওটা তারই গাড়ি। ড্রাইভিং সীটে বসা লোকটাকে চিনতে পারছে না ও। পিছনের সীটে আরও একজন বসে রয়েছে, তাকে ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। গাড়ির দরজা খুলে দিল রকো ল্যাম্পনি, ইশারায় উঠতে বলল কার্লোকে।
ঘাড় ফিরিয়ে মাইকেলের দিকে তাকাল কার্লো।
কনিকে ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি তুমি রওনা হয়ে গেছ, বলল মাইকেল। মাথা নিচু করে গাড়িতে উঠল কার্লো। সিল্কের শার্টটা ভিজে গেছে ঘামে।
কার্লোকে নিয়ে উঠান পেরোচ্ছে গাড়ি। স্পীড বাড়ছে প্রতি মুহূর্তে সঁৎ করে বেরিয়ে গেল ফটক দিয়ে। পিছনের সীটে বসা লোকটা পরিচিত কেউ কিনা দেখার জন্যে ঘাড় ফেরাতে যাচ্ছে কার্লো।
ছোট মেয়েরা যেভাবে অনায়াস দক্ষতার সাথে বিড়াল ছানার গলায় সিল্কের ফিতে পরিয়ে দেয়, পাট ক্লেমেঞ্জাও তেমনি চট করে ফাসটা পরিয়ে দিল কার্লোর গলায় রশির দুই প্রান্ত ধরে হ্যাঁচকা টান দিতেই সেটা কার্লোর গলার চারদিকে এঁটে গেল। বঁড়শিতে আটকানো মাছের মত শূন্যে লাফিয়ে উঠল কার্লোর শরীর। তৈরি ছিল ক্লেমেঞ্জা, রশিটা ছাড়ল না সে। গায়ের জোরে আরও টান করল সেটা, যধাব কষে দিল ফাসটাকে। কয়েক সেকেন্ডেই নেতিয়ে পড়ল কার্লো। শেষ হয়ে গেছে ক্লেমেঞ্জার কাজ, কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্যে টান করে ধরে রাখল রশিটা আরও কিছুক্ষণ।
তারপর ফাঁস খুলে রশিটা গুছিয়ে নিয়ে পকেটে ভরল সে কার্লোর নিষ্প্রাণ শরীর পড়ে গেল সীট থেকে দরজার গায়ে কাত হয়ে রয়েছে নাটের পিছনে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে ক্লেমেঞ্জা।
.
পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টায় রক্তগঙ্গা বয়ে গেল নিউ ইয়র্কে ছাব্বিশ ঘণ্টা পেরোবার আগেই সম্পূর্ণ হলো কর্লিয়নি পরিবারের বিজয় একের পর এক সুখবর আসছে চারদিক থেকে। কিন্তু কর্নিয়ানদের কেউ বিজয়ের উল্লাসে ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দিল না প্রত্যেকের চেহারায় পরম তৃপ্তি এবং দৃঢ় আত্মবিশ্বন ফুটে উঠল বটে, কিন্তু সবার চালচলনে আশ্চর্য একটা সমাহিত ভাব দৃষ্টি এড়াল না কারও। প্রতিটি সুসংবাদ প্রশান্ত গাভীর্যের সাথে গ্রহণ করছে মাইকেল কর্লিয়নি। তার সামনে একটা অতিরিক্ত শব্দ উচ্চারণ করার দুঃসাহস দেখাল না কেউ, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা তো দূরের কথা। অনেক চমকপ্রদ সুখবর,এল, অপ্রত্যাশিত অনেক সাফল্য ধরা দিন পরিবারের হাতে, কিন্তু খবরগুলো গ্রহণ করার সময় মাইকেল কর্লিয়নির চোখের পাতা নড়তে দেখল না কেউ, গর্বে তার বুক ফুলে উঠতে দেখল না কেউ, আনন্দে তার চোখ চিকচিক করে উঠতে দেখল না কেউ। বিস্ময়কর সংযম আর ইস্পাতের মত কঠিন ব্যক্তিত্বের চরম দৃষ্টান্ত দেখাল মাইকেল। শুধু অদ্ভুত একটা গভীরতা ফুটে উঠল তার দৃষ্টিতে।