কাঠের খুন্তি দিয়ে এক স্নাইস ঠাণ্ডা পাই ওভেনে গরম করতে দিল দোকানদার। এখনও আঙুল দিয়ে তবলা বাজাচ্ছে খদ্দের, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এতেন থেকে বের করে গরম পাই-এর টুকরোটা কাগজের একটা প্লেটে রাখল দোকান্দার, তারপর প্লেটটা বাড়িয়ে দিল খদ্দেরের দিকে। দোকানদারের চোখে চোখ রেখে প্লেটটা নিল খদ্দের। নিয়ম হলো, খেতে শুরু করার আগেই পাই-এর দাম চুকিয়ে দেয়া, কিন্তু পয়সা বের করার কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না লোকটার মধ্যে। মুচকি একটু হাসল সে, যেন কতদিনের বন্ধ তারা। তারপর জিজ্ঞেস করল, কি ওটা? ওই যে, তোমার শার্টের কলারের কাছে একটু দেখা যাচ্ছে? নিশ্চয়ই উল্কি, তাই না? মনে হচ্ছে মস্ত বড় উক্তি। সবটা দেখতে দেবে আমাকে? আপত্তি করলে আমি কিন্তু দুঃখ পাব।
স্থির পাথর হয়ে গেছে দোকানের মালিক। চট করে চোখ নামিয়ে শার্টের কলারের নিচেটা দেখে নিল সে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বুকের ভেতর হাতুড়ির বাড়ি পড়তে শুরু করেছে ওর। এরই মধ্যে দুই নাকের ফুটোর নিচে, বগলের তলায়, হাতের দুই তালুতে আর কপালে ঘাম দেখা দিয়েছে তার। ঢোক গেলার সময় গলাটা লম্বা হয়ে গেল তার।
শার্টটা খোলো না, ভাই, অনুরোধের সুরে বলল খদ্দের। উল্কিটা দেখাও আমাকে।
দ্রুত মাথা নাড়ল মালিক আপনি ভুল করেছেন। রাতে যে লোকটা কাজ করে তার বুকে উল্কি আছে। আমার নেই। তার কথার সূর থেকেই বোঝা গেল বিদেশী লোক সে।
মৃদু শব্দ করে হেসে উঠল খদ্দের। বিনয়, হাসিখুশি অনুরোধের ভাব মুছে গেছে তার চেহারা থেকে এখনকার হাসিটা কর্কশ, ব্যঙ্গাত্মক, ঘৃণায় বিকৃত। ওসব পায়তারা ছাড়ো, বলল সে। উল্কিটা দেখতে না দিলে এখন আমি আর দুঃখ পাব না, রাগ করব। খোলো, খোলো, শার্ট খুলে দেখতে দাও আমাকে।
একটু একটু করে পিছু হটতে শুরু করেছে দোকানের মালিক। ওভেনটা প্রকাণ্ড, এটার পিছনে গা ঢাকা দেবার কথা ভাবছে সে। নিঃশব্দে হাসল খদ্দের। এবার ডান হাতটা তুলল সে কাউন্টারের ওপর। চকচকে নীল একটা পিস্তল দেখা গেল তার হাতে।
পিস্তলটা দেখেই অসহায় জানোয়ারের মত বিদঘুঁটে একটা আঁ আঁ শব্দ করে উঠল দোকানদার, সেই সাথে পিঠটা বেঁকে গেল তার, সাপের মত ভঙ্গিতে হত দুটো তুলল কপালের সামনে, যেন মুখ আর মাথাটাকে রক্ষা করতে চাইছে।
এত ভয়? অবাক বিস্ময়ে মাথা নেড়ে বলল খদ্দের, চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে গেছে তার, কিন্তু দৃষ্টিতে জ্বল জ্বল করছে রাজ্যের মজা আর কৌতুক। তারপর মাথাটা একটু সরিয়ে কান পাতার ভঙ্গি করল সে। একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছে। মুখ থেকে নেমে এসে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো দোকানদারের তলপেটের নিচে। এখনও হচ্ছে শব্দটা–ছর-ছর, ছরছর। নোংরা একটা কিছু ঘটতে দেখলে মানুষ যেমন দাঁত দিয়ে জিভ কাটে, খদ্দেরও তার জিভের ডগাটা বাইরে বের করে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল আরে শালা. এ যে মেয়েমানুষের বাড়া! কথাটা বলে নিঃশব্দে হাসল আবার সে।
এখনও পিছু হটছে দোকানদার হাত তুলে পিস্তল তাক করল খদ্দের। দোকানদারের চোখের দৃষ্টি পিস্তলের নল দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেছে, গভীর কালে ফুটোটা যেন তাকে সম্মোহিত করে ফেলেছে। প্রচণ্ড একটা ধাক্কা মারল তাকে প্রথম বলেটটা, ছিটকে ওভেনের ওপর পড়ে গেল সে। কাউন্টার ঘুরে দোকানের ভেতর ঢুকল খদ্দের মেঝেতে জমে থাকা পেছাব টপকে দোকানদারের সামনে দাঁড়া সে বুক থেকে হড়হড় করে রক্ত বেরিয়ে আসছে ঝুঁকে পড়ল খদ্দের! হাত বাড়া শার্টের দিকে। একটা একটা করে খুলে ফেলল কয়েকটা বোতাম। বুলেটের ফুটোটা দেখা যাচ্ছে এখন আঘাতটা মারাত্মক নয়। হার্টেও বেঁধেনি, ফুসফুলও ফুটো। করেনি। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে উল্কিটা। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আছে প্রেমিক প্রেমিকার যুগল মূর্তি। ছোরাটা দুজনের গায়েই বিঁধেছে। আরও একটা গুলি করল খদ্দের। ওভেন থেকে ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেল মালিক। ইচ্ছে করেই আজেবাজে জায়গায় গুলি করছে সে। এখুনি নয়, আরও দুচার সেকেন্ড পর লক্ষ্য স্থির করে গুলি করার ইচ্ছে তার।
মুচকি হাসিটা আবার ফিরে এল খদ্দেরের মুখে! মাত্র দশটা সেকেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা সে, কিন্তু একজন মৃধুপথযাত্রী লোকের কাছে এই দশটা সেকেও দশ যুগের সমান, কিংবা হয়তো তার চেয়েও বেশি।
ফ্যাব্রিযযিয়ো, বলল খদ্দের অকারণে দেরি করছে সে, কেন কি ঘটছে, নিশ্চয়ই তা বুঝতে পারছ?
মাথাটা কাঁপছে ফ্যাব্রিযযিয়োর। কাঁপা মাথাটা দ্রুত কক্ষেবার এদিক ওদিক নাড়ল সে তারপর আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে একটা হাত তুলল মুখের সামনে। চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে তার, যেন এখুনি কেঁদে ফেলবে।
ফ্যাব্রিযযিয়ো, মাইকেল কর্নিয়নি তোমাকে সালাম জানিয়েছে।
কথা শেষ কবে নিঃশব্দে হাসল খদ্দের, হাতটা বাড়িয়ে, দি দোকানদারের মাথার দিকে, পিস্তলের নলটা তার চুলে ঠেকিয়ে আবার টিপে দিল ট্রিগার!
গুলি করেই ঘুরে দাঁড়াল খদ্দের, একবারও পিছন দিকে না তাকিয়ে দ্রুত দোকান থেকে বেরিয়ে এল সে ফুটপাথের ধারেই অপেক্ষা করছে একটা গাড়ি। দরজাটা খোলা। লাফ দিয়ে গাড়িতে চড়ল নোকটা স্টার্ট দেয়াই ছিল, সাথে সাথে তীব্র একটা ঝাঁকি খেয়ে ছুটতে শুরু করল গাড়ি।
.
লং বীচ। উঠান।
ফটকের গায়ে লোহার একটা থাম, থামের গায়ে একটা খোপ, সেই খোপের ভেতর ঝন ঝন শব্দে বাজছে টেলিফোনের বেল ছো মেরে রিসিভারটা তুলে নিল বকে ল্যাম্পনি রেডি, অপর প্রান্ত থেকে বলল কেউ কট করে শব্দ হলো একটা, বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল যোগাযোগ।